বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:২৩ এএম
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কন্যাশিশু বোঝা নয়, সম্পদ

কন্যাশিশু বোঝা নয়, সম্পদ

পুত্রসন্তান না হওয়ার ক্ষোভে যত কন্যাসন্তান হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা দেশের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আদমশুমারির তথ্যমতে, বর্তমান বাংলাদেশে বছরে শূন্য থেকে ১৭ বয়স বয়সী ২ কোটি ৯১ লাখ ৮১ হাজার কন্যাশিশু রয়েছে। সরকারি তথ্যে জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু, যাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই কন্যাশিশু। অথচ দেশের প্রচলিত সামাজিক অসচেতনতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবজনিত কারণে ছেলেশিশুদের সঙ্গে কন্যাশিশুদের রয়েছে ঢের বৈষম্য।

একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আজ লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে মানসিকতার বৈকল্য চোখে পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজের কন্যাশিশুরাই বেশি অবহেলা, বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় এসেও ছেলেসন্তানকে বংশের প্রদীপ মনে করা হয়। কন্যাসন্তান জন্মের ক্ষেত্রে একজন নারী বা পুরুষের ভূমিকা কতটুকু—এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক সত্য বেশিরভাগ পুরুষই মানতে চান না। যার ফলে অসংখ্য নারী এ সমাজে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অভিযোগে নারীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি কন্যাসন্তান নিয়ে পারিবারিক কলহে কখনো মা কখনোবা বাবা সন্তানকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। বারবার কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়ার কারণে একাধিক বিয়ে বা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে। যে নারীশিশু পরিবারের কাছে এত অবহেলিত তাদেরই আবার দেশের উৎপাদনশীলতা এবং এবং নানা শ্রমের কাজে লাগানো হচ্ছে। আইএলওর তথ্যসূত্র মতে, বিশ্বে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত মোট শিশুর ৫ দশমিক ৬ শতাংশই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এবং শিশু শ্রমিকের মধ্যে একটি বিশাল অংশ হচ্ছে কন্যাশিশু। বাংলাদেশে দরিদ্র, অসহায় শিশুরা শুধু অধিকারবঞ্চিতই নয়, বরং এসব শিশুকে যেসব কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগানো হচ্ছে, তা একজন ছেলেশিশু বা মেয়েশিশুর পক্ষে করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। এমনকি শিশুদের নির্যাতন করে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। বাংলাদেশে কন্যাশিশুরা গৃহস্থালি কাজে মাকে স্বাভাবিকক্রমেই সাহায্য-সহযোগিতা করে, যা অন্যান্য পুত্রসন্তান করে না। কিন্তু কন্যাশিশুর এ ধরনের শ্রমের কোনো হিসাব করা হয় না। এর বাইরে দরিদ্র পরিবারের কন্যাশিশুদের গৃহভৃত্যের কাজে লাগানো হলে সেখানে দুবেলা দুমুঠো খাবারের বিনিময়ে দিনরাত খেটে যেতে হয়। বাড়ির পুরুষ সদস্যের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয় অনেক কন্যাশিশুকে। অমানবিক এসব ধরনের অত্যাচার সহ্য করে পালানোর পথ না পেয়ে কন্যা গৃহভৃত্যদের আত্মহত্যা করার ঘটনাও বিরল নয়। এসব ঘটনার জন্য দায়ী গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির কম।

বাংলাদেশে এখনো সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা তাদের ছেলেসন্তান হোক। কন্যাসন্তান জন্মের পূর্বক্ষণে ডাক্তার বা নার্স প্রসূতি মায়ের মানসিক অবস্থা যাচাইয়ের জন্য এর আগে জন্মানো সন্তান পুত্র নাকি কন্যা তা জিজ্ঞেস করেন। সমাজব্যবস্থার প্রচলিত ধারা ও অসচ্ছলতার কারণে পরিবার বিশ্বাস করে, ছেলেসন্তান বড় হয়ে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করবে। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবে। এমনকি পুত্রসন্তান বংশের বাতি জ্বালিয়ে রাখবে। বিয়ের পর কন্যাসন্তান অন্যের ঘরে চলে গেলে সে পিতৃপরিবারের আর কোনো কাজে আসবে না। বর্তমানে প্রেক্ষাপট অনেকটা পরিবর্তিত হলেও সমাজে মা-বাবাদের মনমানসিকতার তেমন কোনো বদল হয়নি। তাই সন্তান জন্ম নেওয়ার আগেই নবজাতক কন্যা হবে নাকি পুত্র হবে, তা যাচাই করতে চিকিৎসকের কাছে মা-বাবা নিশ্চিত হতে নিতে চান। বিশ্ব শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন ৩০ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। কন্যাশিশুর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব আরোপ ও কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্যহীন আচরণের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, শিশুদের সবার জন্য নিরাপদ, বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে তোলাই এসব দিবস পালনের লক্ষ্য। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্যই মূলত শিশুশ্রম ও কন্যাশিশুর প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য দায়ী। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, অবহেলা, অনাদর একদিকে যেমন কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সৃষ্টি করছে নানা সামাজিক সমস্যার। আর যৌন নিপীড়িত বা ধর্ষণের শিকার হলে তো কথাই নেই। কন্যাশিশুদের গৃহকর্মী হিসেবে ব্যাপকভাবে নিযুক্তি সৃষ্টি করছে এক ভয়ংকর সামাজিক সমস্যার। অন্যদিকে পরের গৃহে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত হওয়া কন্যাশিশুরা মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে ব্যর্থ হয়। কন্যাশিশুদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ বন্ধ, কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োজিত করার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর করা প্রয়োজন। শিক্ষাবঞ্চিত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শিশুদের স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ দানের পর তাদের ঝুঁকিমুক্ত কাজের সংস্থানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। কন্যাশিশু নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও কন্যাশিশু শ্রমের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। শিশুশ্রম প্রতিরোধকে সফল করে তুলতে শিশুনীতির কার্যকর বাস্তবায়ন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ বন্ধ করা, আইএলও কনভেনশন ১৮২ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও ১৩৮ অনুসমর্থন করাসহ পথশিশু, ছিন্নমূল শিশু ও শিশুশ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করতে হবে। অধিকারবঞ্চিত কন্যাশিশুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। কন্যাশিশুদের জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি পিতা-মাতা তাদের পুত্র বা কন্যা উভয়কে সন্তান হিসেবে গণ্য করে খাদ্য, পোশাক, শিক্ষাদানে সমান সুযোগ করে দিতে হবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের সফল নেতৃত্বের বিকাশে কন্যাশিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ৭

সাতসকালে ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’

দক্ষিণ চীন সাগরে নতুন তেলের খনি আবিষ্কার

লক্ষ্মীপুরে ৬ বছরের শিশু গুলিবিদ্ধ

মার্কিন-রুশ সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে দ্বিতীয় বৈঠকের ভেন্যু নির্ধারণ

গাজায় নিহত আরও ৪২ ফিলিস্তিনি

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

০২ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

০২ এপ্রিল : ইতিহাসের এই দিনে যা ঘটেছিল

তারেক রহমানের উপহার পেলেন শহীদ আইয়ুবের পরিবার

১০

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই গোষ্ঠীর ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ

১১

স্বামীর কবর দেখতে গিয়ে ‘মারধরের’ শিকার জুলাই শহীদের স্ত্রী

১২

বিএনপি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবে না : এ্যানি

১৩

ঈদে মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু

১৪

‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রই আর টিকবে না’

১৫

চাঁদপুরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষ

১৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া

১৭

ঈদ মিছিল নিয়ে হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি

১৮

সিলেটে মধ্যরাতে বিএনপি-যুবদল সংঘর্ষ

১৯

প্রতারণার শিকার জবি শিক্ষার্থীর পাশে ছাত্রদল নেতা

২০
X