আলম রায়হান
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৩ এএম
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নির্বাচনে অভিনব থেরাপি

নির্বাচনে অভিনব থেরাপি

সূর্য পূর্বদিকে উদয় হওয়ার মতো পিলে চমকানো খবর, বরিশাল সদর আসনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কোমর বেঁধে নেমেছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এর অর্থ এই নয় যে, এটিই বাংলাদেশে একমাত্র ঘটনা, বরং এবার এ ধরনের প্রার্থীর ছড়াছড়ি চারশ ছাড়িয়েছে। যেন স্বতন্ত্র আওয়ামী প্রার্থীর হাটবাজার। ফলে আতঙ্কে অনেক হেভিওয়েটের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এর ওপর আবার আওয়ামী ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নানাভাবে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। আর আবদুর রহমানের মতো যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেন, তাদের উদ্দেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘দলের ডামি ক্যান্ডিডেট দেখেই এ অবস্থা, জামায়াত-বিএনপি নির্বাচনে এলে কী করতেন!’ যেন অন্নতেই ছন্ন! এটিও তেমন বড় খবর নয় যে, সেরনিয়াবাত সাদিক বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রধান কথা হচ্ছে, তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদদের রাজনৈতিক ও রক্তের উত্তরাধিকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সেই রাতে নিহত হয়েছেন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। তিনি সাদিকের দাদা। আর সেদিন ঘটনাচক্রে বেঁচে যাওয়া তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করে বরিশাল বিভাগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধরে রেখেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন শক্ত ভিত্তির ওপর। এ অঞ্চলে আওয়ামী রাজনীতির পরবর্তী কান্ডারি হিসেবে এরই মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য করেছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। আর তিনিই কি না নির্বাচনে নেমেছেন আওয়ামী লীগের প্রতীকের নৌকার বিরুদ্ধে! বড়ই বিস্ময়ের কথা। তবে ইকোয়েশন কিন্তু সোজা। এটি হচ্ছে, কঠিন বাস্তবতার নির্বাচনে বাকশালী থেরাপি। তবে আধখ্যাঁচড়া। কাককে ময়ূরপুচ্ছ পরালে যা হয়!

কিঞ্চিৎ পেছনে ফেরা যাক। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং জাতীয় লীগ নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয় এ প্ল্যাটফর্ম। রাজনৈতিক এ ফ্রন্ট দ্বিতীয় বিপ্লব নামক তত্ত্বের অধীনে রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বাকশাল ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পরিষদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় এক জনসভায় বাকশাল নিয়ে বক্তব্যে ঘুণেধরা সমাজ পাল্টানোর কথা বলেছিলেন। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিব যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতি তাকে বাকশাল ব্যবস্থার পথে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণাকারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুরশিদা বেগমের অভিমত, ‘বাকশাল গঠনের পেছনে প্রতিকূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয় যেমন ছিল, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন ছিল।’ গবেষক খুরশিদা বেগমের মূল্যায়ন, ‘যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা যেটা ছিল, একেবারে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। আমাদের কলকারখানা সব নষ্ট বা ভেঙে গেছে। রাস্তাঘাট বা অবকাঠামো নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ চলছে না। কোষাগার শূন্য। এক কোটি মানুষ ফিরে এসেছে ভারত থেকে। এই যে একটা অবস্থা, সেই সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও কিন্তু বসে থাকল না এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো ছিল না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে দেশটাকে সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে এই বাকশাল গঠন করেছেন।’ লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের জন্য তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে দলের একটি অংশ বেরিয়ে যাওয়ার পর সরকার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল। সেখানে তাদের সহমতের দল সিপিবিসহ অন্যদের নিয়ে একটা সংগঠন করা দরকার ছিল এবং যেটা সামাল দিতে পারে। শেখ মুজিব তা মনে করেছিলেন। সেজন্যই তিনি বাকশাল করেছিলেন।’

এদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উচ্ছেদ করার পাশাপাশি বাকশাল ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয়। এরপর লাগাতারভাবে নানা ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার পাশাপাশি বাকশাল ব্যবস্থা অচ্ছুত ও দানবীয় বিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ক্রমাগত অপপ্রচারে। এ অপপ্রচারের বর্ম ভেদ করে বঙ্গবন্ধুকে সমহিমায় ফিরিয়ে আনা হলেও বাকশাল আর শুদ্ধ ইমেজ পায়নি। হয়তো বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ধারক এবং বেনিফিশিয়ারিরাও বাকশালের প্রত্যাবর্তন চাননি। অথবা বিশ্ব বাস্তবতা এতটাই বৈরী ছিল যে, সমাজতান্ত্রিক ধারার বাকশাল ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না। ফলে এটি এক ধরনের ‘অপ শব্দের’ তকমা ধারণ করেই রয়ে গেল। কিন্তু সংকটে যে বাকশাল ব্যবস্থার উপযোগ অনিবার্য, তা এবার সংসদ নির্বাচনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। স্মরণ করা যেতে পারে, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু এমন একটি পদ্ধতি এনেছিলেন, যেখানে কেউ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে যে যে প্রার্থী হবে, সবার নাম একটি পোস্টারে দিয়ে প্রচার করার বিধান ছিল। যে ব্যক্তি যত বেশি জনগণের কাছে যেতে পারবে, জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে, সেই শুধু নির্বাচিত হবে। এ পদ্ধতিতে দুটি নির্বাচন হয়। একটি হয়েছিল কিশোরগঞ্জে, সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাই জনগণের ভোটে একজন স্কুলমাস্টারের কাছে হেরেছেন। আর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় পটুয়াখালীতে।

যদিও আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে বাকশালের বিষয়ে ইতিবাচক কথা শোনা যায় না। গুণকীর্তন তো একবারেই না। তবে ইতিবাচক কথা একাধিকবার বলেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘বাকশাল থাকলে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকত না।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) কার্যকর থাকলে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্কই থাকত না। বাকশাল ছিল সর্বোত্তম পন্থা। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যে পদ্ধতিটা (বাকশাল) করে গিয়েছিলেন, সেটা যদি কার্যকর করতে পারতেন তাহলে এসব (নির্বাচনী অস্বচ্ছতা) প্রশ্ন আর উঠত না। আর বঙ্গবন্ধু চাইলেন, মানুষ যেন তার ভোটের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে। যে অধিকার তিনি দিয়েছিলেন ৭২-এর সংবিধানে। বাকশাল বাংলাদেশের জন্য উপযোগী ছিল দাবি করে আওয়ামী লীগপ্রধান বলেছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য যে কতটা উপযোগী ছিল, একসময় বাংলাদেশের মানুষ তা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধু যে পদ্ধতিটা করে গিয়েছিলেন, সেটা যদি কার্যকর করতে পারতেন তাহলে এসব প্রশ্ন (নির্বাচনে অস্বচ্ছতা) আর আসত না। সব থেকে জনদরদি যে ব্যক্তিটি জনসেবা করে, সেই নির্বাচিত হয়ে আসতে পারত।

বঙ্গবন্ধুকন্যা আসলে বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন। আর বাকশাল মোটেই একদলীয় শাসন ছিল না। এটি ছিল বহু দলের একটি মোর্চা, যা বহু পথ ও মতকে ধারণ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। আর এর নির্বাচন ব্যবস্থা ছিল আমাদের অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে আধুনিক ও উপযোগী। যার যার মতো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিধান ছিল। জনগণের সুযোগ ছিল নিজের মতো করে নেতা নির্বাচিত করা। এ ক্ষেত্রে জনগণই ছিল মুখ্য। প্রার্থী মনোনয়নের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে মনোনয়ন-বাণিজ্য অথবা এরকমের অন্য কোনো কালো অধ্যায় ছায়া ফেলতে পারত না। পরীক্ষার আগেই এ বিধান মুছে ফেলা হলো। কিন্তু বাকশালী বিধান ফিরে না এলেও এবারের নির্বাচনে বাকশালী থেরাপির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ধারায়, ঘটা করে নৌকার মনোনয়ন ঘোষণা করা হলেও দলের অন্য নেতাদের পথ রুদ্ধ করা হয়নি। বরং গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে এই দলেরই নেতাকর্মীর সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে বাধা নেই। বরং নানানভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মানলেই নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আর থাকল না। বরং আওয়ামী লীগ করেন এমন যে কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়া মানেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়া। এদিকে একই আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রার্থী আছেন। আছেন অন্যান্য দলের এবং নির্দলীয় প্রার্থীও। ফলে ভোটারদের ভোটদানের অপশনে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। থাকল না কোনো প্রবাসী ব্যক্তিবিশেষের একগুঁয়েমিতে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে জিম্মি করার সুযোগ। আর মনোনয়ন-বাণিজ্য তো একেবারে মাঠে মারা গেছে, হাটের মাঝখানে গণপিটুনিতে ধরাসাই গরু চোরের মতো।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় নাটোরবাসীর মিলনমেলা শুক্রবার

সোনারগাঁয়ে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

১০

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১১

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১২

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১৩

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

১৪

চীন যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, হবে যেসব আলোচনা

১৫

শৈশবের বন্ধুদের প্রিয় কবিতা শোনালেন মির্জা ফখরুল

১৬

পুতুল-টিউলিপসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

১৭

পুতুলকে ‘হু’ থেকে অপসারণে অনলাইনে চলছে গণস্বাক্ষর, ব্যাপক সাড়া

১৮

চটপটির দোকানে ২৩৪ কোটি টাকা ঋণ, অনুসন্ধান করবে দুদক

১৯

ভুয়া আসামি দাঁড় করিয়ে জামিন, ৪ জনের নামে মামলার নির্দেশ আদালতের

২০
X