সৈয়দ ফারুক হোসেন
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৪৮ এএম
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও আমাদের সতর্কতা

সৈয়দ ফারুক হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
সৈয়দ ফারুক হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশে মাঝারিমাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। শনিবার সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটির স্থায়িত্ব সময়সীমা ছিল ৩৩-৩৫ সেকেন্ড। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫.৬। তাৎক্ষণিকভাবে এর উৎপত্তিস্থল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ ও কুমিল্লা অংশে বলে জানা গেছে। এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। এটি মাঝারি শ্রেণির ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের সময় রাজধানীতে অনেকেই আতঙ্কে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ভীতি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনে। এদিকে রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া থেকেও ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পৃথিবীতে ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার প্রযুক্তি এখনো মানুষের আয়ত্তের বাইরে। সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো অসহায় দেশে স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তদুপরি দুর্যোগসহিষ্ণু জাতি হিসেবে ভূমিকম্পের ক্ষতি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, দালান-কোঠা নির্মাণে কোড অনুসরণ, জনসচেতনতা সৃষ্টি, সর্বোপরি অদম্য মনোবলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ভৌগোলিকভাবে নাজুক অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশ। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। কারণ, বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় ভূমিকম্পে কেঁপেছে বিশ্ব। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে কেন্দ্র থেকে ভূকম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এ কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাইরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়ই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়—প্রচণ্ড, মাঝারি ও মৃদু। উৎসের গভীরতা অনুসারে ভূমিকম্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়াবহ। ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে বারবার আঘাত হানে। প্রতিবছরই কোনো না কোনো দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ভূমিকম্পে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল তুরস্ক ও সিরিয়া। প্রতিদিনই শত শত নতুন মৃত্যু যুক্ত হয়েছিল। যখন ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে তখন বেশিরভাগ মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বহুতল ভবন ঘুমন্ত মানুষের ওপর মোমের মতো ধসে পড়েছে। চারদিকে লাশ আর লাশ। প্রাণহানির সংখ্যা ছাড়িয়েছে হাজার থেকে লাখে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত থেকে ধর্মীয় স্থাপনা। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে একমুহূর্তে। প্রতিবছরই নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে চলেছে আমাদের নিবাসবিশ্ব। বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তা অনুমান করা অসম্ভব। ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস নেই। ফলে মানুষ সতর্কতামূলক কোনো পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে না। বড় ধরনের ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অসংখ্য ঘরবাড়ি ধসে পড়বে; রাস্তাঘাট, সেতু ভেঙে পড়বে; মানুষসহ অসংখ্য প্রাণী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, অনেক মানুষ দেয়ালচাপায় মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করবে। তা ছাড়া জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র ধ্বংস হয়ে পড়বে। সবশেষে আমরা বলতে পারি যে, যদি কখনো বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে সারা দেশ একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন সেগুলো হলো—আমরা যে ভবনটিতে থাকি সেই ভবনটি ভূমিকম্পরোধক কি না, তা জানতে হবে। থাকলে কত মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় এবং না থাকলে দুর্বল ভবনে রেট্রোফিটিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবারের সবার সঙ্গে বসে আশ্রয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। বিছানার পাশে সবসময় টর্চলাইট, ব্যাটারি ও জুতো রাখতে হবে। প্রতিবছর পরিবারের সবার সঙ্গে ভূমিকম্পের করণীয় সম্পর্কে ট্রায়াল দিতে হবে। ভূমিকম্পের সময় যা যা করণীয় সেগুলো হলো—ভূমিকম্প শুরু হলে ছোটাছুটি না করে স্থির থাকা। বাইরে বের হওয়া, ছাদ বা জানালা দিয়ে লাফ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ভূমিকম্প শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়তে হবে। তারপর কোনো ডেস্ক বা টেবিলের নিচে প্রবেশ করতে হবে। ভবনে ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থা থাকলে ভবন ধসের সম্ভাবনা কম থাকে। সুতরাং তখন ভবনে অবস্থান করাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহার করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং সে সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহার পরিহার করা প্রয়োজন। ভূমিকম্পের সময় গাড়িতে থাকলে গাড়ি বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকা। গাড়ির বাইরে বের হলে আহত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। মেইন শক বা মূল ভূমিকম্প হওয়ার আগে ও পরে মৃদু বা মাঝারিমাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাকে বলা হয় ‘ফোরশক’ ও ‘আফটারশক’। এ সময়ও সতর্ক থাকতে হবে। কেননা ‘আফটারশক বা ‘ফোরশক’ থেকেও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। প্রথম ভূমিকম্পের সময় সম্ভব না হলেও পরে গ্যাস ও বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া। ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়লে যা যা করণীয় সেগুলো হলো—হাতে রুমাল, টাওয়েল বা চাদর থাকলে হালকাভাবে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। যাতে ধ্বংসস্তূপের ধুলোবালি নাকে, মুখে প্রবেশ করতে না পারে। হাতে টর্চ থাকলে জ্বালান, ম্যাচ না জ্বালানো। কেননা গ্যাসের পাইপ লিক থাকলে আগুন লেগে যেতে পারে। কাউকে চিৎকার করে না ডেকে মুখে শিস বাজিয়ে, হাতে রেফারির বাঁশি থাকলে বাঁশি বাজিয়ে অথবা কোনো কিছুতে শব্দ করে ডাকা। এতে মুখে ধুলোবালি প্রবেশ করবে না। সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প সবচেয়ে বেশি বিধ্বংসী। এই বিধ্বংসী ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় বা পূর্বাভাস নেই। ভূমিকম্প রেখার ঝুঁকিপূর্ণ সীমানার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আমাদের শক্তিশালী ভূমিকম্পের বিপর্যয় মোকাবিলা করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশে অনেকবার বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও, বেশিমাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি হালকাভাবে না নিয়ে এখনই ভবন নির্মাণের জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও দুর্বল স্থাপনাগুলো চিহ্নিতকরণপূর্বক ভেঙে ফেলতে হবে। প্রত্যেকটি বিপর্যয়ের ধরন আবার আলাদা রকমের। পৃথিবীর ওপর আঘাত হানতে পারে বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যার জেরে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের পৃথিবী। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে বেশি ভূমিকম্প এক মহাপ্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম। সহজ কথায় পৃথিবীর কেঁপে ওঠাই হলো ভূমিকম্প। এ ছাড়া বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, নদীভাঙন ইত্যাদি ব্যাপক বিধ্বংসী এসব অনাহুত জঞ্জাল তো আছেই। তবে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলো ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন তাই ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। একমাত্র প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিই পারে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে সহনশীল দেশ গড়তে।

লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X