উপমহাদেশের মতো ক্রিকেট উন্মাদনা আর কোথাও দেখি না। কোথাও নেই এত আনন্দ, এত বিদ্বেষ, এত উত্তেজনা। উপমহাদেশের দেশগুলোর জনপ্রিয় ফুটবল এখন হাহাকার করছে। সকার বিশ্বকাপ ছাড়া আর কোনো খেলাই মানুষকে টানে না। বাদবাকি যে কোনো খেলা তো রূপকথার গল্প। খেলাগুলো খাতায় আছে বা মাঠে থাকলেও হৃদয়ে নেই। মানুষের মনে এত ক্রিকেটপ্রেম? যারা ব্যাটিং বোঝে না, ফিল্ডিং বোঝে না, ডিপ লেগ বা মিড উইকেট চেনে না, এমনকি কত বলে এক ওভার তাও ঠিকমতো জানে না, তারাও ক্রিকেটপ্রেমী। অনেকে মনে করেন, এর পেছনে একদিকে যেমন হুজুগ, আরেকদিকে আছে জুয়া। সে কথায় পরে আসছি।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কেমন তা কলকাতা থাকাকালে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। যেসব হোটেলে রুম ভাড়া ছিল ১০-১১ হাজার টাকা, সেগুলো রাতারাতি ২৫ থেকে ৫০ হাজার হয়ে গেল। তাও ঠাঁই নেই। এ অবস্থা ভারতের সব শহরের। মনে রাখতে হবে, উপমহাদেশে ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, এ এক ধরনের জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ। পাকিস্তান-ভারতের খেলা কি আদৌ কোনো খেলা? এই খেলা কি শুধু মাঠে হয়? কোটি কোটি মানুষের ঘরে ঘরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আগেই। বাজিকর, জুয়াড়ি, পাগল, অর্ধপাগল সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ তারা জানে এটাই সুবর্ণ সুযোগ। জানলে অবাক হবেন, এসব খেলা যেখানে বাংলাদেশের নাম-গন্ধ নেই, সে খেলার জুয়া হয় দেশের শহরে-মফস্বলে। চায়ের দোকানে এমন জুয়ার আসরে বিনিয়োগকারী এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ড্রাইভারের গল্প শুনে বিস্মিত হয়েছি। যার মানে এই, ক্রিকেট তার শক্তি দুর্বলতা সবকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আর তার আক্রমণে কুপোকাত মানুষজন। মিডিয়াগুলোর দিকে তাকালে অবাক হওয়ার বিকল্প দেখি না। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশের মিডিয়াও কম যায় না। ক্রিকেট মাঠে গড়ানোর আগেই মিডিয়ায় শুরু হবে দেশপ্রেমের নামে উত্তেজনা ছড়ানো। পাকিস্তানি মিডিয়ার কথা আর বললাম না। তাদের কাছে ভারতকে হারানো মানেই বিশ্বকাপ জয়। একসময় পাকিস্তানের সেলিম দুররানি, হানিফ মোহাম্মদ, আসিফ ইকবাল বা ইমরান খানদের কাছে পর্যুদস্ত ভারতের এখন অন্য চেহারা। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, শুভমান গিলদের কাছে কোণঠাসা বাবর আজমরা এখন ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। এই যে পাল্টে যাওয়া ভারত, এর পেছনে তাদের উন্নয়ন, তাদের লগ্নি, তাদের রুপির জোরও কম নয়। কে জানে কোন খেলা আসলে কোথায় নির্ধারিত হয়? বদলে যাওয়া ভারতকে কেউ চটাতে রাজি না। আইসিসির সবচেয়ে ডাকসাইটে সদস্য ভারত। তাদের চটানো অনুচিত ভেবেই কাজ চলে। এ কথা বলছি না যে, ভারতের ক্রিকেট এখন সাধারণ কিছু। বরং এক থেকে দশ নম্বর সব খেলোয়াড়ের ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। একটা টোটাল স্পিরিট নিয়ে খেলছে রোহিত শর্মার দল, সে জায়গায় শ্রদ্ধা রেখেই বাকি কথাগুলো বলা।
আমার বর্তমান আবাসভূমি সিডনি। ২৬-২৭ বছর এ দেশে বসবাস করি। এটা কম কোনো সময় নয়। দুনিয়ার যে কোনো খেলায় অস্ট্রেলিয়া আছে শীর্ষে। আপনি অলিম্পিক বলুন আর ক্রিকেট বলুন, হোক সে সাঁতার বা দৌড়—সবকিছুতেই এগিয়ে আছে ২ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার এ দেশ। কীভাবে সম্ভব? এই যে অজি ক্রিকেট, তার এত রমরমা, আপনি সিডনিতে এলে টেরই পাবেন না। যে রাতে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ জেতে, মানুষরা এমনভাবে ঘুমায় যেন বহু রাত অনিদ্রায় ছিল তারা। পরদিন মিডিয়া জুড়ে হৈহৈ। যুবশক্তি বা খেলাপ্রিয় মানুষরা মেতে ওঠে আড্ডা-গল্প আর খানাপিনায়। মনে হবে রুটিনমাফিক কোনো খেলায় জিতে ফিরছে দেশের দল। কিন্তু তফাতটা কী জানেন? যেসব মানুষ খেলাটি নিয়ে কথা বলবে বা আগ্রহ প্রকাশ করবে, তারা জানে তারা কী বলছে। আপনি বরং অবাক হয়ে যাবেন তাদের সেন্স আর খেলার মূল্যায়ন শুনে। মনে হবে যেন কোনো প্রাক্তন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলছেন। কলকাতায় এর কিছুটা দেখতে পেলেও বাংলাদেশের পরিবেশ পুরো উল্টো।
আমাদের ক্রিকেট দল ও কর্তারা খারাপ ফলাফলের পর হাসিমুখে বহাল তবিয়তে দেশে ফিরল এবং নিউজ হলো—এর জন্য কি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কেউ? সামাজিক মিডিয়ায় তা থাকলেও আসল মিডিয়া ভয়েই কথা বলে না। ভয় এমনই শক্ত আসন গেড়ে বসেছে যে, পরিবর্তনের প্রয়োজন কানের কাছ ঘেঁষে গেলেও আমরা চোখ খুলতে ভয় পাই। সবাই জানেন শীর্ষ পদে পরিবর্তন মানে কারও অপমান বা অপসারণ নয়, এটাই আসলে নিয়ম। একজন বহু বছর থাকলে তার চিন্তা চেতনাও পুরোনো হয়ে পড়ে। নতুন একজন এলে রাতারাতি সবকিছু ভালো হয়ে যাবে তেমনটা নয়, মূলত একটা নতুন নেতৃত্ব হয়তো নতুন দিশা দিতে পারে। সে কথাটা বলাও দেশে বিপজ্জনক। এরকম একটা অচলায়তনে থাকা সমাজের ক্রিকেটে দেশপ্রেম থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। তার প্রমাণ মিলেছে হাতে হাতে। শ্রীলঙ্কার ম্যাথুজকে টাইমড আউট করায় আমাদের দেশের নব্য উদারনৈতিকদের যে আস্ফালন দেখলাম, তাতে আমি সত্যি বিস্মিত হয়েছি। আমি তো জানি মানুষ বিপদের সময় দেশের জন্য বুক বেঁধে দাঁড়ায়। খেলায় যখন আমাদের হারটা নিয়মে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন জয়ের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য কৌশল অবলম্বন করা যেতেই পারে। তা ছাড়া নন্দিত খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান কোনো অন্যায় করেছিলেন কি? তিনি আইন মোতাবেক তার চাওয়া জানিয়েছিলেন, দেওয়ার মালিক তো আম্পায়ার। তিনি না দিলে কি জোর করে নেওয়া যেত? অথচ হঠাৎ করে বাঙালি এমন উদার হয়ে গেল যে, দেশ-জাতি ভুলে কঠোর সমালোচনায় মেতে উঠল। যে জাতির পরতে পরতে দুর্নীতি, যাদের একটি কাজও সোজা পথে হয় না, যে সমাজে ঘুষ আর অনিয়মই নিয়ম, তাদের হঠাৎ এমন ভালো হয়ে যাওয়ার ভেতর যে ক্রোধ আর হিংসা, সেটাই অবাক করেছে। দেশ ও জাতির প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকলেও তারা এটি করতে পারত না। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এবারের বিশ্বকাপে আমাদের অর্জন কি আসলেই কম? নাকি আমরা তৈরি হতে পারছি না? আমার মনে হয়েছে দলগত শৃঙ্খলা থাকলেও কোথাও দ্বন্দ্ব আছে। বিশেষ করে খেলতে যাওয়ার আগে সিনিয়র ক্রিকেটার তামিম আর সাকিবের বাদানুবাদ ও দোষারোপ মনোবল ভেঙে দেওয়ার কাজ করেছে। এ ছাড়া ডোনাল্ড-হাথুরুসিংহের ফ্যাসাদও এখন প্রায় প্রকাশ্য। টাকার ওপর ভর করে চলা বোর্ডের জানা উচিত মূল বিষয় কিন্তু খেলা ও জয়। নয়তো এ রমরমা ভাব টিকবে না।
উপমহাদেশের ক্রিকেট শঙ্কারও জন্ম দিচ্ছে বৈকি। দেশে দেশে দুশমনি আর ঝগড়া কোনো খেলার উদ্দেশ্য হতে পারে না। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে এ দেশের লড়াই চলছে, চলবে; কিন্তু তা দেশজ ফাইট বা লড়াই কিছু নয়।
এবার বাংলাদেশের ক্রিকেট যা পেয়েছে তার নাম অভিজ্ঞতা। উপমহাদেশে টিকতে হলে এটাই পুঁজি করতে হবে। ক্রিকেট যে ভদ্রজনোচিত খেলা এবং তার মর্যাদা বেশি, এটা মানার মতো, জানার মতো খেলোয়াড়রাই পারবে সামনে এগিয়ে নিতে। মাঠে উত্তেজনা বিশ্বাস বা অন্ধত্ব কোনো কাজে আসবে না।
জয় হোক খেলার। জয় হোক নির্মল ক্রিকেটের।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার, সিডনিপ্রবাসী