২০২২ সালের শেষাংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে রাজপথের আন্দোলন শুরু করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। একই দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে আন্দোলন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ সবকটি রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ। ১৯৯৫-৯৬ সালের আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয় বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিতর্কিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ। এ সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ কোনো বিরোধী দল অংশ নেয়নি, একমাত্র ব্যতিক্রম, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দল ফ্রিডম পার্টি। নির্বাচনটি ‘১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন’ নামে সমধিক বিতর্কিত, যার আয়ুষ্কাল ছিল ১১ দিন। এ সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত আসামি কর্নেল ফারুক (অব.)।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে পাস করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানের অধীনে সে বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ; বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে সরকার পরিচালনা করার দায়িত্ব সাংবিধানিক নিয়মে হস্তান্তর করে। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগেই বিচারপতি লতিফুর রহমানের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন আসনে জামায়াত-বিএনপি জোটের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষপাতিত্বের চিত্র ফুটে উঠে গণমাধ্যমে। পক্ষপাতিত্বপূর্ণ নির্বাচনটিতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নৈতিকতা হারায়; জিতে যায় জামায়াত-বিএনপি জোট।
২০০১ সালে সরকার গঠন করার পরপরই একদিকে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের নেতৃত্বে তৈরি হয় দুর্নীতির হাওয়া ভবন। পরপর পাঁচবার তারা দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। তারেক রহমানের সরাসরি নেতৃত্বে এবং বেগম জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো হয় নারকীয় গ্রেনেড হামলা। সে হামলা চলাকালে হত্যার উদ্দেশ্যে সরাসরি গুলি করা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার প্রতি। গুলিতে নিহত হন তার দেহরক্ষী। মানবঢাল তৈরি করা জীবনরক্ষা করা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যার। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এ গ্রেনেড হামলায় কেন্দ্রীয় নেতারাসহ নিহত হন ২৪ জন।
অন্যদিকে সামনের জাতীয় নির্বাচনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে জামায়াত-বিএনপি জোট প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ আজিজকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে প্রাক্তন বিএনপি নেতা বিচারপতি কে এম হাসানের নিয়োগকে নিশ্চিত করার জন্য বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো হয়। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে না পেরে অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সরকারের ক্ষমতা দখল করেন জামায়াত-বিএনপি জোট নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ।
এত কিছু করেও শেষরক্ষা হয়নি জামায়াত-বিএনপি জোটের। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে দুই বছর ধরে সরকার পরিচালনা করেন অসাংবিধানিকভাবে। ক্ষমতা দখল করে ফখরুদ্দীন সরকার বাংলাদেশকে রাজনীতিশূন্য করার উদ্দেশ্যে কার্যকর করতে শুরু করেন ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। রাজনীতি নিষিদ্ধ অবস্থায় রাজনৈতিক দল খুলতে সচেষ্ট হন নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস। আবারও ভূলুণ্ঠিত হয় তথাকথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইজ্জত। কোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া কাজে আসেনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে বাধ্য হয় মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার। সে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। জনপ্রতিনিধিত্বহীন বলে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ বলে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। সে রায়ের ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বহুল অপব্যবহৃত ও বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে সর্বোচ্চ আদালত ঘোষিত অবৈধ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অবৈধ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই থেকে শুরু করে দেশের সব নির্বাচনই কমবেশি বিতর্কিত হয়েছে। তথাকথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর অধীনে আয়োজিত নির্বাচনগুলোরও প্রতিটি সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল পরিসরে বিতর্কিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দেশে বারবার পরীক্ষিত হয়েছে, তা থেকে ভালো কিছু পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বারবার সাপলুডু খেলার চোরাগোপ্তা পথ চিরতরে বন্ধ করে দিতে হলে অন্যান্য সব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও সব সময়ের জন্য রাখতে হবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ পরিচালনায় রাজনীতি ভিন্ন অন্য কোনো শক্তির নাক গলানোর সুযোগ থাকতে পারে না। এ চাওয়া সহজ, বাস্তবায়ন করা কঠিন। এ কঠিন কাজটিতে বাধা দিতে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে মরিয়া হয়ে নেমেছে ৩ নভেম্বর, ১৫ ও ২১ আগস্টের খুনিদের দল, কানাডার আদালতে কয়েকবার সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত অবৈধ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সৃষ্ট দল বিএনপি। তারা এতকিছুর পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে।
২০২২ সালের শেষ ভাগ থেকে শুরু হওয়া চলমান জামায়াত-বিএনপি জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আন্দোলন প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে হটিয়ে আবারও দেশকে তার নিজস্ব গতিপথ থেকে বিচ্যুত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই চলবে। এ প্রশ্নে জামায়াত-বিএনপি-সুশীল অশুভ শক্তিকে ছাড় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। জনগণ সে ছাড় দিচ্ছেও না। বছরখানেকের বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই। আন্দোলনকারীদের জনসমাবেশে তাদের ক্ষমতালোভী, লুটেরা মানসিকতার নেতাকর্মী ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। মির্জা ফখরুলের প্রতিদিনকার বাস্তবতাবিবর্জিত বক্তব্য হাস্যকর শোনায়। দেশ কোথায় চলছে আর তিনি কী বলছেন! গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ডাক দিয়ে তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে, বিচারপতি কমপ্লেক্সে, পুলিশ হাসপাতালে, অডিট ভবনে হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করে, ৩০ জনের অধিক সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ চালায় এবং নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে পুলিশ হত্যা করে। জামায়াত-বিএনপির এ মহাসমাবেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির ইতি ঘটেছে। নির্বাচন নিয়ে বারবার ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্বাচিত সরকারের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। জামায়াত-বিএনপি অশুভ শক্তি যতদিন ক্রীড়াশীল থাকবে, ততদিন এ ব্যবস্থা অনায়াসে টেকসই হবে না। অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সব গণতান্ত্রিক শক্তি মিলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির পরিচর্যা করতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা।
লেখক : চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক