বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিচক্র খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না। তারা সবসময় একটা পাল্টা অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় ছিল। কেননা ঢাকা তখন এক অস্থির নগরী। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতার অন্ত ছিল না, প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছিল দৃশ্যপট, একের পর এক চলছিল অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি। আর এ পাল্টা আঘাত এলে তা কীভাবে প্রতিহত করা হবে, এ নিয়ে খুনিচক্র ছিল ভীষণ উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে পাল্টা অভ্যুত্থানের পাশাপাশি খন্দকার মোশতাকের প্রধান অস্বস্তি ছিল আওয়ামী লীগের মধ্যে বিদ্রোহের আশঙ্কা। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা তখন দিশেহারা। চার জাতীয় নেতাসহ প্রায় ৭৫ জন এমপি-মন্ত্রী কারাগারে। এর বাইরে অনেকে আত্মগোপনে, কেউ কেউ রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। কয়েকজনকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে মোশতাক মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিতে বাধ্য করেছেন বটে, কিন্তু এ সত্ত্বেও খন্দকার মোশতাকের মধ্যে আওয়ামী লীগ-ভীতি ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে আরও দুর্বল করতে মোশতাক জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর পাশাপাশি ফারুক ও রশিদ সিদ্ধান্ত নেয়, পাল্টা অভ্যুত্থানে যদি মোশতাককে হত্যা করা হয়, তাহলে দুটি বিষয় অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। প্রথমে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ করতে হবে, যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো শূন্যতার সৃষ্টি না হয়। একই সঙ্গে মোশতাকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি ঘাতক দল পাঠিয়ে জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করতে হবে। এ জন্য তারা পাঁচজনের একটি ঘাতক দল গঠন করে। ঠান্ডা মাথায় খুনের ব্যাপারে এ ঘাতক দলের সদস্যরা ছিল বিশেষভাবে পারদর্শী। এই দলের দায়িত্ব দেওয়া হয় রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর তাকে অনারারি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হয়। ১৫ আগস্ট শেখ মনির বাসায় হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিল এই মুসলেহ উদ্দিন। পাক-মার্কিন চক্র অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় চার নেতা হত্যার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করে। আওয়ামী লীগ যাতে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারে, মূলত সেজন্যই জেলে বন্দি চার নেতাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবেই খুনিচক্র তাদের সব সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
১৫ আগস্টের পর বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশিদরা ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখত। তারা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাদের ওপর পাল্টা আঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে মোশতাক এ বিষয়ে আলোচনা করেন তার দুই ঘনিষ্ঠ অনুচর কর্নেল ফারুক আর রশিদের সঙ্গে। আলোচনাকালে মোশতাক বলেন, ‘পাল্টা সেনা বিদ্রোহ হলে আমাদের প্রথম কাজ হবে জেলে বন্দি মুজিবের চার বিশ্বস্ত সহকর্মী—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া।’
ফারুক বলল, তাই নাকি?
মোশতাক বলেন, ‘হ্যাঁ তা-ই! খালেদ মোশাররফ শেখ মুজিবের প্রতি সবসময়ই অনুগত। শুধু সে নয়, তার মা, ভাই, পরিবারের প্রত্যেক লোকই। সে যদি বঙ্গভবনে ধাক্কা দেয়, তাহলে তা দেবে শেখ মুজিবের নামেই। আর তখন সে মুজিবের প্রতিনিধি হিসেবে জেলে বন্দি ওই চার নেতাকে সামনে আনবে। খালেদ মোশাররফকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না।’
চক্রান্তকারীদের আশঙ্কা মিথ্যা ছিল না, খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহ করে আর এ পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কর্নেল ফারুক তার দলের পাঁচজনকে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। তাদের নেতৃত্বে ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের অন্যতম সেই রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন।
সেই কালরাতের কথা
রাত তখন প্রায় দেড়টা। কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশে থমথমে নীরবতা। একটি গাড়ি গিয়ে থামল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল গেটে। গেটের পাহারাদার ধমকে উঠল, ‘তোমরা কারা?’ গাড়ির দরজা খুলে বাইরে আসে পাঁচ খুনি। পরনে সামরিক পোশাক, হাতে লাইট মেশিনগান। পাহারাদারদের কাছে গিয়ে মুসলেহ উদ্দিন বলল, ‘আমরা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে এসেছি। গেট খোলো। ভেতরে যাব।’
পাহারাদারদের জবাব, ‘না। রাতে ফটক খোলা যাবে না। হুকুম নেই।’ সঙ্গে সঙ্গে মুসলেহ উদ্দিনের চিৎকার, ‘গেট খোলো। নইলে বিপদ হবে বলছি।’
মূল গেটের সামনে এভাবে কথাবার্তা চলতে থাকে। একসময় রাত ৩টা বেজে যায়। গেটের সামনে চিৎকার, শোরগোলের কারণে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন কাজী আবদুল আউয়ালকে খবর দেওয়া হলো। তিনি এসে বললেন, ‘বাইরের কেউ রাতে জেলে ঢুকতে পারবে না। এটাই আইন এবং নিয়ম। আমাদের তো সেই আইন মেনে চলতে হবে।’
এতে মুসলেহ উদ্দিনের গলা একটু শান্ত হলো আর একটু নিচুস্বরে বলল, ‘আইনের মালিক তো দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনিই আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা তারই লোক।’ ডিআইজি বলেন, ‘মহামান্য প্রেসিডেন্টের কোনো লিখিত নির্দেশ আছে।’
‘না। তা নেই। তবে আপনি তাকে ফোন করুন। তাহলেই সব বুঝতে পারবেন।’
ডিআইজি (প্রিজন) ফোন করেন প্রেসিডেন্ট ভবনে।
কর্নেল রশিদ ফোন ধরে জিজ্ঞেস করল, কে?
‘আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি বলছি। মহামান্য প্রেসিডেন্টকে চাই।’
রশিদ সবই বুঝতে পারল। তাই আর কিছু না বলে ফোনটি তুলে দেয় খন্দকার মোশতাকের হাতে।
মোশতাক বলেন, ‘কে বলছ?’
‘আমি স্যার, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ডিআইজি।’
‘কী চাই?’
‘ওরা বলছে, ওরা নাকি আপনার লোক। আপনিই নাকি ওদের পাঠিয়েছেন। কথাটা কি ঠিক?’
এবার খন্দকার মোশতাক চড়া গলায় বলেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওরা আমারই লোক। ওদের জেলের ভেতরে যেতে দাও। ওরা তোমায় যা করতে বলে তা-ই করো। এটা আমার ‘অর্ডার’। আমার আদেশ।”
খন্দকার মোশতাক ফোনের রিসিভারটা সশব্দে নামিয়ে রাখলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি (প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল অত্যন্ত বিমর্ষ মনে মোশতাকের আদেশ পালন করতে শুরু করলেন। জেলের প্রধান গেট খুলে দিলেন। মুসলেহ উদ্দিন ও তার চার সঙ্গী দ্রুত জেলের ভেতরে ঢুকল। কিন্তু ওই চার জাতীয় নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান কোন সেলে থাকেন, সেটা মুসলেহ উদ্দিনের জানা ছিল না। অস্ত্র তুলে এক পাহারাদারকে জিজ্ঞেস করতেই সে আঙুল তুলে দিকটা দেখিয়ে দিল। চার জাতীয় নেতা ছিলেন পাশাপাশি দুটি সেলে। এক ‘সেলে’ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ। অন্যটিতে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। খুনিরা চারজনকে একটি ‘সেলে’ এনে জড়ো করে। সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নেন।
আমিনুর রহমান বর্ণনা করেন, “তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম, আর্মি আসছে। চারজনকে একটি কক্ষে একত্র করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগার কারণে সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালাগাল করছিল। মনসুর আলী সাহেব বসা ছিলেন সর্বদক্ষিণে, যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই। এর পরই ঘটে বিশ্ব ইতিহাসের এক বর্বরতম ঘটনা। খুনিরা গুলি চালায় ওই চার নেতার ওপর। খুব কাছে থেকে। লাইট মেশিনগানের গুলি।
“রক্তের ঢল নামে বন্দিশালার ওই ‘সেলের’ চত্বরে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পায়ে ও ঊরুতে গুলি লেগেছিল। তিনি অনেকক্ষণ বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যু হয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। পাশের সেলের বন্দিরা পরে বলেন, তিনি করুণ কণ্ঠে বারবার ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিৎকার করেছিলেন। খুনিরা ওই সেলের দরজায় তালা দিয়ে গিয়েছিল। তাই মৃত্যুর আগে তাকে কেউ পানি দিতে পারেননি।
“কারাগারের ভেতরে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেননি। তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার কারাগারের খোঁজ নেওয়ার জন্য সারা দিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। পরের দিন, অর্থাৎ ৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান যে তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন। ৪ নভেম্বর বিকেল ৪টার দিকে খবর আসতে শুরু করল, তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।”
মামলার কার্যক্রম বন্ধ করেন জিয়া
জেলখানায় প্রতিদিন ভোরে, অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা পরপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিতে হয়। জেলহত্যার পর তৎকালীন জেলার মো. আমিনুর রহমান একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামান হাওলাদারকে দেন। পাশাপাশি ৪ নভেম্বর কারা কর্তৃপক্ষ লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করে। মামলায় রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচ সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। প্রথমে গুলি করে, পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতকরা।
মামলা দায়েরের পরদিন (৫ নভেম্বর) আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামান হাওলাদার জেলহত্যার প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে জমা দেন। ৬ নভেম্বর বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেনের সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপটে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলে তিনি এই তদন্ত কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে জেলহত্যার তদন্ত প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওইদিন সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যখন জিয়ার সঙ্গে মেজর ডালিমের দেখা হয়, তখন জিয়া উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে ডালিমকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘কাম হিয়ার, ইউ হ্যাভ ডান সাস এ গ্রেট জব! কিস মি! কিস মি!!’ এর উত্তরে ডালিম বলেছিল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, ইউ আর দ্য হিরো অব ইনট্যায়ার শো।’
জেনারেল জিয়া সম্পর্কে ডালিমের এই মূল্যায়ন যথার্থ। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, এই পৈশাচিক হত্যার বিচার বন্ধে সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পাস, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা এবং এ হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যপরিচালনায় বাধা দেওয়া, ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা, আইয়ুব-ইয়াহিয়ার কায়দায় ক্ষমতা দখলের পর একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের পুনর্বাসন, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের শিরোমণিদের মন্ত্রী বানানো, এরপর দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ, দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করা, একের পর এক ক্যু প্রতিহত করতে প্রহসনের বিচারে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মাধ্যমে জিয়া নিজেই প্রমাণ করেছেন, তিনি ছিলেন সিরিয়াল কিলার এবং ঠান্ডা মাথার খুনি।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা