নানান ঘটনায় আমরা ইউনিক। এর মধ্যে এক নম্বরে আছে আমাদের মন্ত্রীদের বচন। আলোচিত একটি সিনেমা আছে, কুলি নাম্বার ওয়ান। তেমনই আমাদের মন্ত্রীরাও নাম্বার ওয়ান। একসময় মন্ত্রীদের বচন পিআইডির প্যাকেটে বিশেষ বাহক মারফত পত্রিকা অফিসে পাঠানো হতো এবং সবচেয়ে জুনিয়র অথবা শিফট ইনচার্জের অপছন্দের সাংবাদিককে মন্ত্রীদের কথামালা কেটেকুটে প্রকাশ উপযুক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হতো। কালের আবর্তে এখন মন্ত্রীবচন তাদের অফিস কিংবা বাসায় ধরনা দিয়ে বিশাল বিশাল ক্যামেরায় ধারণ করেন সবচেয়ে চৌকস সাংবাদিকরা এবং তা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয় টেলিভিশনে। অবশ্য পত্রিকায় এখনো এ পর্যায়ে নামেনি। যুগের হাওয়া অথবা দৈন্যতার প্রভাবে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে মন্ত্রীবচন, যা কারও কারও বিবেচনায় অমৃতসম, কারও বিবেচনায় চরম বিরক্তির। আর এ বচনের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই মন্ত্রীরা অনেক পরিশ্রম করেন এবং হয়তো অনেক ভাবেনও। কিন্তু একেবারেই হয়তো ভাবেন না, তাদের অনেক বচনেই মানুষ চরম বিরক্ত হয়। গরমও হয় কেউ কেউ। মন্ত্রীদের বচনের প্রভাবে কাকও ‘কাউয়া’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে এবং এটি তারই নামের সঙ্গে যুক্ত করে ব্যঙ্গ করেন কেউ কেউ। এদিকে রাজনীতিতে আওয়াজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, ‘খেলা হবে’, যা রাজনীতিতে কুরুচির মডেল হিসেবে বিবেচিত। এসবই হচ্ছে মন্ত্রীবচনের বাই প্রোডাক্ট। এদিকে মন্ত্রীবচন আসছে বিরামহীন। এর মধ্যে অনেকের বিবেচনায় মন্ত্রীবচন ২২ অক্টোবর অনন্য এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। ওইদিন যে মন্ত্রীরা বচন উদগিরণ করেছেন, তাদের মধ্যে ওবায়দুল কাদের, টিপু মুনশি ও আবদুল মোমেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কথাবার্তায় এ তিনজন বরাবরই বেশ আলোচিত। উল্লেখ্য, ত্রিরত্ন বলে একটি বেশ রসালো সিনেমা আছে। কিন্তু ২২ অক্টোবর অতীতের সব মন্ত্রীকে ছাপিয়ে অনন্য এক উচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যদিও তিনি বরাবরই কম কথা বলেন। যাও বলেন, তাও বলেন মেপে মেপে, চেপে চেপে। কম কথা বলার ক্ষেত্রে অনেকেই তার মধ্যে খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর প্রতিচ্ছবি দেখেন। কিন্তু চলমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমন কথা বলে ফেলেছেন, যাতে দুপুরে তার কথা অসত্য বলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসকে বিবৃতি দিতে হয়েছে রাতে। অবশ্য, কোনপক্ষের কথা সত্য, তা ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়ে গেছে। কিন্তু কোনো ধোঁয়াশা নেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য নিয়ে। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে ঢাকাকে মনে হয় ইউরোপ। আর নামলেই আমাদের বাসগুলো দেখলে মনে হয় গরিব গরিব চেহারা। জীর্ণ, মুড়ির টিন চলছে। গায়ে লেখা আল্লাহর নামে চলিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘মালিক সমিতিকে বলব, এসব গাড়ি কীভাবে চলে ঢাকা শহরে? এ কথা কতবার বললাম। কী লাভ হলো? কথা অনেক বলেছি। কথা কাজে পরিণত না হলে মূল্য থাকে না।’ সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ তিনি দেশের আসল চেহারা অনুধাবন করতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা আছে। যাতে তিনি বিমান থেকে বন্যায় প্লাবিত দেশ দেখতে বারণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। কারণ ওপর থেকে সর্বনাশা প্লাবনের জলরাশি মনোহর হিসেবে ধরা দিয়ে আহ্লাদে মুখ থেকে ‘আহ’ শব্দ বেরিয়ে যেতে পারে। মানে ওপর থেকে দেখলে বাস্তবতা অনুধাবন করা যায় না। বরং উল্টোই মনে হতে পারে। বিলম্বে হলেও যার প্রমাণ পেয়েছেন আমাদের সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। আসলে মন্ত্রীদের উচিত ওপর থেকে নয়, নিচ থেকেই দেখা। তাতে বাস্তবতা অনুধাবন সহজ হবে। বলে রাখা ভালো, দেশের মানুষ কিন্তু এ নিচেরটাই দেখে। এমনকি স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ নিচের অসংখ্য চর দেখে। যার প্রভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে যাওয়ার আনন্দ ভুলে নিচের দৃশ্যে ব্যথিত হয়। এটি সেতুমন্ত্রীসহ সবার বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এদিকে আরেকটি ভালো কথা বলেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আসবে বলে জানিয়েছেন। তবে সরকার তাদের খরচ বহন করবে না।’ খুবই সরেস বচন। টাক মাথায় কৃত্রিম কালো চুলের আচ্ছাদনধারী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের টাকা নিয়ে ভাবনার আওয়াজ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি জানেন, তার এ বচন নিয়ে দেশের মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। তাদের আগ্রহ এবং আতঙ্ক আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে এবং উদ্বেগের প্রশ্ন, নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশিদের অতি আগ্রহকেন্দ্রিক। এ ক্ষেত্রে দেশবাসী অন্ধকারে আছে। অনেকটা একই অবস্থা খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরও। ২২ অক্টোবর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কথিত ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ শেষে ব্রিফকালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’ কিন্তু এটি যে কার বিষয়, তা নিয়ে কিন্তু বেশ ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আবার অন্যরকম ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সাংবাদিকদের ব্রিফকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি বক্তব্য এবং রাতে নাকচ করে দেওয়া ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, ‘আগামী ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে সড়ক বন্ধ করা হবে কি না, তা জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’ কিন্তু ওইদিন রাতেই মার্কিন দূতাবাসের প্রেস কর্মকর্তা স্টিফেন আইভ্যালি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বৈঠকে আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সড়ক বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা হয়নি।’ বিবৃতিতে স্টিফেন উল্লেখ করেন, ‘রাষ্ট্রদূত হাস বৈঠকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও হস্তক্ষেপমুক্ত অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে সত্য বলছেন? আর পর্দার অন্তরালে ঘটনা প্রবাহ নিয়ে সত্যটা আসলে কী! এই পরিস্থিতি কি রাজনীতিকদের অর্জিত নাকি আরোপিত? গভীরের ঘটনা যাই হোক, রাজনীতিকদের বোধোদয় হওয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর এক বৈঠকের দিকে নজর ফেরানো যাক। আলোচনা স্থলের লবিতে ভুট্টোকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সমস্যা রাজনৈতিক, রাজনৈতিকভাবেই আমাদের সমাধান করতে হবে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী টানা ঠিক হবে না।’ বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর এ কথা ভুট্টো আমলে নেননি। তিনি রাজনীতির পরিবর্তে সামরিক ব্যবস্থার দিকেই ঝুঁকে ছিলেন। তার এ ঝোক তাকে সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল এবং এ ধারা তাকে নিয়ে গেছে ফাঁসির মঞ্চে। নির্ভরতার সেনাবাহিনীই তাকে ফাঁসিতে লটকিয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা সম্প্রতি বিদেশিদের দিকে ঝুঁকেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, একসময় পরাশক্তি বিশ্বপরাশক্তি বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করত। পরে নিজেরাই অভিযান শুরু করে দিল। যে ধারায় ধ্বংস হলো ইরাক-লিবিয়া। এ ধারার সঙ্গে জড়িয়েছে রাজনীতিকরা। পাশাপাশি ব্যবহার করছে ইসরায়েল ও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে। পরাশক্তি অধুনা ধুয়া তুলেছে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে। তবে লক্ষ্য কিন্তু আগের মতোই থেকে গেছে। আর তাদেরই আমাদের দেশের রাজনীতিকরা তোষণ করছেন। এমনকি কেউ অবতার, এমনকি বাবাও বলছেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাদের দেশের পরাশক্তির ওপরই নির্ভর করছেন, যা বানরের পিঠা ভাগের গল্পের চেয়েও অনেক বড় কুফল বয়ে আনতে পারে। কাজেই রাজনীতিকদের হুঁশে ফিরে আসা প্রয়োজন। অবশ্য, এ সময় এখন আর আছে কি না, তাও এক বড় প্রশ্ন।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক