বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩, ০৯:০১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

হাসিমুখে থাকা মহানবীর আদর্শ

হাসিমুখে থাকা মহানবীর আদর্শ

মানুষের চেহারাকে বলা হয় মনের আয়না। যার হৃদয় যত স্বচ্ছ ও সুন্দর, তার মুখে হাসির উদ্ভাসও তত বেশি। হাসি মানুষকে সজীব ও সতেজ রাখে, আয়ু ও কর্মোদ্যম বৃদ্ধি করে এবং ইহকাল-পরকালের শান্তি নিশ্চিত করে। মানুষের হৃদয়েও একটা তালা আছে আর সেই তালার চাবি হচ্ছে মুখের হাসি। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও স্মিতহাস্যের মাধ্যমে খুব সহজেই মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করা যায়। হাসির মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসা, হৃদ্যতা, কল্যাণ ও মমতাবোধ তৈরি হয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। এটা ইমান ও বিশ্বাসেরও দাবি। হাসিমুখের মাধ্যমে অন্যের হৃদয়ে যেমন জায়গা করে নেওয়া যায় তেমনি নিজের দাগহীন হৃদয়ের সচ্ছতাও প্রকাশ প্রায়। মুচকি হাসি, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও কথাবার্তায় নম্রতা তখনই আসে যখন হৃদয় স্বচ্ছ ও সুন্দর থাকে। এ কাজগুলো হতে হয় অন্তরের গভীর থেকে। হৃদয়কে মমতাময়, সজীব ও কোমল করে গড়ে তুললে মনের অজান্তেই মুচকি হাসি মুখাবয়ব উজ্জ্বল করে। হৃদয়ের স্বচ্ছতার ব্যাপারে হাদিসে সুন্দর বিবরণ আছে। সাহাবি আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে বলা হলো, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? নবীজি বললেন, প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি। তারা বললেন, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি, কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? নবীজি বলেন, ‘সে হচ্ছে পূত-পবিত্র ও নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ, যার কোনো পাপ নেই, কোনো শত্রতা নেই, কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, আত্ম-অহমিকা ও কপটতা নেই।’ (ইবনে মাজা : ৪২১৬)

ইসলামে হাসির তিনটি প্রকার আছে—১. ‘তাবাসসুম’ অর্থাৎ মুচকি হাসি। এ হাসিতে দাঁতও দেখা যায় না, শব্দও হয় না; মুখে ঝুলে থাকে হাসির রেখা। মহানবী স্বভাবগতভাবে এ হাসির ভূষণে শোভিত ছিলেন। আপন-পর, বন্ধু-শত্রু সবার সঙ্গে তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন। আবদুল্লাহ ইবনে হারিস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর চেয়ে বেশি মুচকি হাসতে আমি আর কাউকে দেখিনি।’ (তিরমিজি : ৩৬৪১)। এ হাসিই উম্মতের জন্য সুন্নত ও আদর্শ। ২. ‘দিহক’ বা উচ্চকিত হাসি; যে হাসিতে দাঁত দেখা যায়, হালকা শব্দ হয় কিংবা শব্দ হয় না। এভাবে হাসা জায়েজ, তবে না হাসাই উত্তম। ৩. ‘কাহকাহা’ বা অট্টহাসি। এটি নির্লজ্জ ও অহংকারী লোকদের হাসি এবং এতে চেহারার আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। তাই ইসলামে অট্টহাসি নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, এতে অন্তর মরে যায়। নামাজে অট্টহাসি দিলে নামাজও ভেঙে যায়, অজুও ভেঙে যায়। অট্টহাসি সবসময়ের জন্য বর্জন করা উচিত এবং মুচকি হাসি সবসময়ের জন্য অর্জন করা উচিত। এ তিন প্রকার হাসির মধ্যে মুচকি হাসিকে ইসলামে ভালো কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কখনো এ হাসিতে (আওয়াজ ছাড়া) দাঁত প্রকাশ পেলেও কোনো সমস্যা নেই।

ইসলামে হাসি একই সঙ্গে সামাজিক সৌজন্যেরও অংশ এবং ইবাদতেরও অংশ। নবীজি নিজে যেমন সবসময় হাসিমুখে থাকতেন, তেমনি হাস্যমুখ করে থাকাকে ইবাদত বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। আবু জার (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে দেখা করা তোমার জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি : ১৯৫৬)। প্রশ্ন হতে পারে, হাসিমুখে কথা বললে কীভাবে সদকা হয়? সদকার মাধ্যমে যেভাবে মানুষ অন্যের মনে আনন্দ জাগিয়ে তোলে, তেমনি হাসিমুখে কথা বললেও মানুষ আনন্দিত হয়; তাই হাসিমুখে কথা বলা সদকাস্বরূপ। এমনকি তা অনেক সময় দানের চেয়েও অধিক ভূমিকা পালন করে। এ জন্যই রাসুল (সা.) সাহাবাদের সঙ্গে মুচকি হাসি ছাড়া কখনোই কথা বলতেন না। জারির (রা.) বলেন, ‘আমি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছি, তখন থেকে রাসুল (সা.) আমাকে তার কাছে প্রবেশ করতে বাধা দেননি এবং যখনই তিনি আমার চেহারার দিকে তাকাতেন, তখন মুচকি হাসতেন।’ (বুখারি : ৩০৩৫)। অর্থাৎ ইসলামে হাসিমুখে থাকাটাও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ একটি আমল। নিজে হাসিমুখে থাকা যেমন সুন্নত, তেমনি অন্য কাউকে হাসতে দেখলেও দোয়া পড়া সুন্নত। কাউকে হাসতে দেখলে তার হাসিমুখ অমলিন রাখতে হাদিসে একটি দোয়া পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। দোয়াটি হলো—‘আদহাকাল্লাহু সিন্নাকা’, অর্থাৎ, ‘আল্লাহ আপনাকে চিরহাসিমুখ রাখুন।’ রাসুল (সা.)-কে হাসতে দেখে ওমর (রা.) এ দোয়া পাঠ করেন। (বুখারি : ৩২৯৪)

মহানবী সবসময় হাসিমুখে মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। এমনভাবে বলতেন, প্রত্যেক সাহাবি মনে করতেন—‘আমাকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন নবীজি।’ এভাবে নবীজি (সা.) সবাইকে কাছে টেনে আপন করে নিতেন। ফলে সাহাবি ও যে কোনো মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারতেন নিঃসংকোচে। সাহাবিরা নবীজির কাছে জীবনঘনিষ্ঠ একান্ত জটিলতার সমাধানও জেনে নিতেন সহজেই। কাব ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘আমি নবীজিকে সালাম করলাম, খুশি ও আনন্দে তার চেহারা ঝলমল করে উঠল। তার চেহারা এমনিই আনন্দে টগবগ করত। মনে হতো যেন চাঁদের একটি টুকরো। তার মুখমণ্ডলের এ অবস্থা হতে আমরা তা বুঝতে পারতাম।’ (বুখারি : ৩৫৫৬)। সাহাবিদের যাপিত জীবনের ঘটনাগুলোতেও নবীজি খুব স্বাভাবিকভাবেই মিশে যেতেন। একান্ত আনমনে কোনো সাহাবি কোনো কথা বললেও নবীজি রাগ না করে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ছড়িয়ে দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা.) বলেন, ‘আমি খায়বার যুদ্ধের সময় চর্বিভর্তি একটি চামড়ার থলে পেলাম। আমি তা তুলে নিলাম এবং বললাম, এর থেকে আমি কাউকে কিছু দেব না। তিনি বলেন, আমি হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি আমার কথা শুনে রাসুল (সা.) মৃদু হাসছেন।’ (মুসলিম : ৪৪৯৬)।

আমাদের সমাজে-সংসারে কাজের লোক কাজে গাফিলতি করলে স্বভাবতই মেজাজ চড়ে যায়। কিন্তু নবীজি কাজের লোকের সঙ্গেও ছিলেন হাসিমুখ। নবীজি যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন দশ বছরের বালক আনাস ইবনে মালেক (রা.)-কে তার মা নবীজির কাজে সাহায্যের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে যান। দশ বছর বয়স থেকে বিশ বছর বয়স অর্থাৎ নবীজি ইন্তেকাল পর্যন্ত ছিলেন একান্ত সহচর। আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দশ বছর নবীজির খেদমত করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো আমার ওপর রাগ হননি। আমার কোনো কাজের জন্য তিনি কখনো বলেননি, তুমি এ কাজ কেন করলে? আর আমি কোনো কাজ না করলেও তিনি জবাবদিহিতা করেননি যে, এ কাজ তুমি কেন করোনি?’ (আনসাবুল আশরাফ : ১/৪৬৪)। আনাস (রা.) আরও বলেন, ‘নবীজি একবার একটি কাজে আমাকে বাইরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু পথে সমবয়সী বালকদের সঙ্গে খেলায় ডুবে যাই। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ পেছন দিক থেকে নবীজি এসে ঘাড়ে হাত রাখেন। পেছন দিকে ফিরে তিনি দেখি, রাসুল (সা.) হাসছেন।’ (আবু দাউদ : ৪৭৭৩)। অর্থাৎ কাজের লোককে কাজে পাঠানোর পর অন্য কাজে ব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও নবীজি রাগ না করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছেন।

হাসি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানবিক ভাষা। মুচকি হাসির মাধ্যমে বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও গভীরতম কথা। পৃথিবীর জন্য রহমত ও শান্তির দূত হিসেবে পাঠানো হয়েছিল যে মহামানবকে, সে মহানবীর মুখে সবসময় লেগে থাকত মুচকি হাসির রেখা। এ হাসির মাধ্যমে জয় করেছেন তিনি সমকাল ও অনন্ত মহাকাল। মহানবীর উম্মত হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য, সবসময় মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখা এবং বন্ধু-শত্রু সবার জন্য হাসিমুখে কথা বলার মতো ঔদার্য হৃদয়ে ধারণ করা। মহানবী জীবনের শেষ দিনেও উম্মতের জন্য উপহার দিয়েছেন জান্নাতি হাসির দ্যুতি। নবীজি যেদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, সেদিন সর্বশেষ উম্মতের দিকে তাকিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন হাসির উপহার। নবীজির ঘরোয়া জীবনের আমৃত্যু সঙ্গী আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘মুসলমানরা সোমবার (রাসুল সা.-এর ওফাতের দিন) ফজরের নামাজে ছিলেন, আবু বকর (রা.) সবাইকে নিয়ে নামাজ আদায় করছিলেন। নবীজি (সা.) আয়েশা (রা.)-এর হুজরার পর্দা সরিয়ে সবার দিকে তাকালেন। তখন সবাই নামাজের জন্য কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে দেখে তিনি মৃদু হাসলেন। ওইদিনই নবীজির ইন্তেকাল হয়।’ (বুখারি : ১২০৫)।

লেখক : মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হার দিয়ে আইপিএল শেষ মোস্তাফিজের

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার : আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করল মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ

ছাত্রীনিবাসের সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও ধারণ, অতঃপর...

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার, বরিশালে মিষ্টি বিতরণ

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলার চেয়ারম্যান হলেন অ্যাড. আব্দুস সালাম

এবার চাঁদের বুকে পা রাখবে পাকিস্তান

মিল্টনের বিরুদ্ধে কালবেলায় উঠে আসা সব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ডিবি

ডিবির ব্রিফিংয়ে উঠে এলো মিল্টনের কিডনি বিক্রির ইস্যু

দেশের মানুষ ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত : মির্জা ফখরুল 

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঠেকাতে বাইডেনের দ্বারস্থ নেতানিয়াহু

১০

সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ বৃহস্পতিবার

১১

নওগাঁয় ধান কাটতে গিয়ে কৃষকের মৃত্যু

১২

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে

১৩

মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি

১৪

ভয়াবহ প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেন মিল্টন : ডিবিপ্রধান

১৫

মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ

১৬

পরিসংখ্যানে বেড়েছে ইলিশ, বাস্তবে তেলের টাকাও উঠছে না জেলেদের

১৭

মিল্টন সমাদ্দারকে রিমান্ডে নেবে ডিবি

১৮

চিকিৎসাসেবাকে মানুষের আস্থার জায়গায় পরিণত করার আহবান প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর

১৯

মানবপাচার ও টর্চার সেল ইস্যু উঠে এলো ডিবির ব্রিফিংয়ে

২০
*/ ?>
X