শংকর মৈত্র
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৪৯ এএম
আপডেট : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আদালতের মর্যাদা ও মামলাজট

আদালতের মর্যাদা ও মামলাজট

রাজনীতিতে একটা ‘অক্টোবর বিপ্লব’ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু অক্টোবর শেষ হয়ে যাচ্ছে এখনো রাজনৈতিক বিপ্লব হয়নি। কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবে অক্টোবরের মাঝামাঝি এসে দেশের উচ্চ আদালতে একই দিনে বৈপ্লবিক দুটি ঘটনা ঘটে গেছে। দুটি ঘটনাই আদালতের মর্যাদা-সংক্রান্ত। আদালত অবমাননার অপরাধে পৃথক দুটি ঘটনায় একজন জনপ্রতিনিধি ও একজন বিচারকের কারাদণ্ড হয়েছে, যা নিয়ে তোলপাড় চলছে আইন ও বিচারাঙ্গনে।

গত ১২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একজন জনপ্রতিনিধিকে আদালত অবমাননার দায়ে জেল-জরিমানা করেছেন। একই দিন হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতের একজন বিচারককে আদালত অবমাননার দায়ে জেল-জরিমানা করেছেন।

একই দিনে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের দুটি আদালত অবমাননার রায় প্রদানের ঘটনা হয়তো কাকতালীয়। তবে এই আদালত অবমাননার ঘটনা নিয়ে আইনাঙ্গনে ও জনমনে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথমেই আপিল বিভাগের আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত রায়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে ইউটিউবে আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব্য করেছেন। এ বক্তব্য ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। তার এই বক্তব্য শুনে বিস্মিতই হয়েছি।

সোজা কথায় বললে সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারক সম্পর্কে একজন রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি এমন ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তার বক্তব্য, সরাসরি আপিল বিভাগের দৃষ্টিতে আনেন কয়েকজন আইনজীবী। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে এই জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ ইস্যু করে ব্যাখ্যা তলব করেন। নোটিশ পেয়ে নির্ধারিত তারিখ ২৪ আগস্ট মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম আপিল বিভাগে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ১২ অক্টোবর শুনানির জন্য ফের তারিখ রাখা হয়। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগে সেদিন হাজির হলে আদালত অবমাননার অপরাধে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে এক মাসের কারাদণ্ড, এক টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৭ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে ৭ দিনের মধ্যে দিনাজপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্যটি শুনেছি। তিনি সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারক সম্পর্কে যে অশ্লীল ও অভব্য ভাষায় কথা বলেছেন, এটা অবশ্যই আদালত ও বিচারকের প্রতি অবমাননাকর। আদালতের মর্যাদা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না।

তবে এখানে যে প্রশ্নটি তোলা যায়, সেটি হলো বিচার বিভাগের শেষ স্তর আপিল বিভাগ। নিম্ন আদালত থেকে যে কোনো মামলা বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে আপিল করে সর্বশেষ ধাপ আপিল বিভাগে পৌঁছাতে হয়। আদালত অবমাননার মামলা যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাইকোর্টে বিচার হয় এবং আপিল বিভাগেও সরাসরি বিচারের এখতিয়ার ও নজির রয়েছে (আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকেও আদালত অবমাননার দায়ে সরাসরি আপিল বিভাগ দণ্ড দিয়েছিলেন)।

সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট একটি ‘কোর্ট অব রেকর্ড।’ এর অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশ দান, দণ্ডাদেশ দানসহ সব ক্ষমতার অধিকার রয়েছে। তারপরও বলা যায়, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আর আপিলের সুযোগ থাকে না। সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগেই শেষ বিচার হয়ে যায়। আপিল বিভাগের রায়ে হয়তো রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকে; কিন্তু সেটাও অনেক কারণে হয় না।

আদালত অবমাননার দণ্ডপ্রাপ্ত মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। তাকে জেলও খাটতে হবে, জরিমানাও দিতে হবে। আর দণ্ডিত হওয়ায় তিনি মেয়র পদও হারাবেন।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সর্বোচ্চ আদালতই নাগরিকদের শেষ আশ্রয়স্থল। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের রক্ষক। এই আদালতের মর্যাদা রক্ষা করা যেমন প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব, তেমনি নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষাতেও আদালতকে ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও আমরা একটি হলে আরেকটি কম দেখতে পাই। নাগরিকের অনেক মৌলিক অধিকার প্রশ্নে আদালতকেও নীরব থাকতে দেখি।

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের যে কোনো আদেশ নির্দেশ অধস্তন আদালতকে অবশ্যই মানতে হবে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে। এই অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে অধস্তন আদালতের বিচারক সোহেল রানা আদালত অবমাননা করেছেন এবং এ জন্য তিনি শাস্তি পেয়েছেন। তবে এখানে সরল বিশ্বাসে কয়েকটি প্রশ্ন তুলতে চাই এবং তা উচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই। আমরা জানি, দেশের আদালতগুলোতে ভয়াবহ মামলাজট। অধস্তন আদালতে ৩৬ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ৫ লাখের বেশি মামলা। মামলাজটের কারণে বিচার বিভাগ ভেঙে পড়ার উপক্রম। যে মামলাটি নিয়ে আলোচিত ঘটনা, সেটা সংখ্যায় বিবেচনা করলে এখন দুটি মামলা। একটি মামলা কুমিল্লার সিজিএম আদালতে আরেকটি হাইকোর্ট বিভাগে। অর্থাৎ একটি মামলা থেকেই এখন দুই আদালতে দুটি মামলার উদ্ভব হলো। ৬ বছর আগে এ মামলার ওপর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়ে রেখেছেন এবং রুল জারি করে বলেছেন, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তি হবে না। অর্থাৎ ৬ বছর ধরে এই রুলের শুনানিও হচ্ছে না মামলাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আবার হাইকোর্টের আদেশের কারণে বিচারিক আদালতেও এ মামলা নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। (নিষ্পত্তি করতে গিয়েই বিচারক আদালত অবমাননার কবলে পড়েছেন)। আর এভাবেই তো মামলাজটের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের লাখ লাখ মামলা হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিচারিক আদালতে অনিস্পন্ন হয়ে আছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মামলাজটের। বিচারপ্রার্থীদের যে কী দুর্ভোগ, তা যারা মামলায় পড়েন তারা বোঝেন; কিন্তু এই দুর্ভোগ লাঘবে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। উচ্চ আদালত যদি তাদের জারি করা রুল ও স্থগিতাদেশ নির্ধারিত সময়ে বা দ্রুততম সময়ে শুনানি করে নিষ্পত্তি করতেন, তা হলে মামলাজট অনেকটাই কমে যেত বলে মনে করেন আইন ও বিচারাঙ্গনের লোকজন। আরেকটা বিষয়, দিনাজপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের আদালত অবমাননার অপরাধটি সরাসরি আপিল বিভাগে বিচার হওয়ায় তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পেলেন না। হয়তো রিভিউ আবেদন করার সুযোগ পাবেন; কিন্তু বিচারক সুহেল রানার অপরাধটি হাইকোর্ট বিভাগে বিচার হওয়ায় তিনি তাৎক্ষণিক আপিল করার সুযোগ পেয়েছেন এবং আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগতি করে তাকে জামিন দিয়েছেন। যদিও দুটি ঘটনার চরিত্র ভিন্ন; কিন্তু বিচার হয়েছে একই আইনে, আদালত অবমাননার অপরাধে। তবে সর্বশেষ কথা হলো, বিচারালয় নাগরিকের শেষ আশ্রয়স্থল। এই পবিত্র স্থানের মর্যাদা ও সম্মান অবশ্যই অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। বিচারালয়ের প্রতি আস্থা রাখতে হবে।

কিন্তু উচ্চ আদালতকেও অনেক ক্ষেত্রে আরও উদার হতে হবে। অন্তত মামলাজট থেকে বিচারপ্রার্থীদের রক্ষা করতে হলে নিম্ন আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের উৎসাহ দিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমরা কোন ব্যর্থ নির্বাচন চাচ্ছি না : জামায়াত আমির

তোফাজ্জলের খুনিরা যেন রেহাই না পায় : লায়ন ফারুক

ফিলিস্তিন নিয়ে সমন্বয়ক সারজিসের স্ট্যাটাস

ভাইরাল সেই সাইনবোর্ড নিয়ে যা জানা গেল

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত

বৃষ্টি নিয়ে সুখবর

গণঅধিকার অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে খুঁটি হিসেবে কাজ করছে

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

‘ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতি হবে না’

ইসরায়েলকে ছাড় দিচ্ছে না প্রতিরোধ যোদ্ধারা

১০

কয়রায় গণঅধিকার পরিষদের আনন্দ মিছিল 

১১

অবশেষে কমলো সোনার দাম

১২

ভারতে টাইগার রবির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

১৩

যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড় হেলেনের ভয়াবহ তাণ্ডব

১৪

মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার নয় : আইজিপি

১৫

বৈরুতে বিপাকে বাংলাদেশিরা, দ্রুত সরে যাওয়ার পরামর্শ

১৬

বিএনপি জনগণের ভালোবাসার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় : নয়ন

১৭

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের’

১৮

আরব শেখদের লালসার শিকার ভারতের কুমারীরাও!

১৯

বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে গেল ৯৯ টন ইলিশ

২০
X