শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৩:১৩ এএম
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তব নীরব বাণী হৃদয়তলে

তব নীরব বাণী হৃদয়তলে

আজ ১৮ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাসভবনে রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। আজ বেঁচে থাকলে রাসেল ৫৯ বছরের প্রবীণ একজন মানুষ হতেন। বাবা বঙ্গবন্ধু বা বড় বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো হয়তো দেশের কল্যাণে অসাধারণ ভূমিকা রাখতেন; কিন্তু পঁচাত্তরের অভিশপ্ত ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন, যা থেকে মুক্তি পায়নি ১০ বছরের ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল। শেখ রাসেল থেকে গেলেন চিরকালের শিশু। শিশু রাসেলের হাসিভরা মুখটিই সর্বদা আমাদের চোখে ভাসে।

বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় লেখক, দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে নাম রেখেছিলেন কনিষ্ঠ সন্তানের। শাহাদাতবরণকালে রাসেল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। স্কুলে রাসেলের সহপাঠীরা বলেন, তাদের এই বন্ধু ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল মিশুক প্রকৃতির। স্কুলের প্রহরী, পিয়ন ও আয়াসহ নিম্ন বেতনের কর্মচারীদের সঙ্গে তার হাসিমুখে কথা বলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বঙ্গবন্ধুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন। পরে ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব পুনর্বহাল করে বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কমুক্ত করেন।

শেখ রাসেল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ডায়েরিতে ১৫ জুন, ১৯৬৬ তারিখে লিখেছেন ‘সাড়ে ৪টায় জেলের লোক এসে বলল, চলুন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আপনার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাসিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না, যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত রাসেল শুধু জানালার দিকে চেয়ে বসে থাকে। বলে আব্বার বাড়ি। এখন ওর ধারণা হইয়াছে ওটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”

রাসেলের দীর্ঘদিনের গৃহশিক্ষক গীতশ্রী দাসগুপ্তা একবার বলেছিলেন, রাসেল কত অতিথিপরায়ণ ছিলেন। গীতশ্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে রাসেলকে বাসায় পড়াতেন। এমনকি পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট রাতেও তিনি রাসেলকে বাসায় পড়িয়ে গেছেন। তার ছাত্র রাসেল সম্পর্কে গীতশ্রী বলছিলেন যে, প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসেল নিজেই শিক্ষকের জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আসতেন এবং তিনি সেগুলো না খাওয়া পর্যন্ত লেখাপড়া শুরু করতেন না। বার বার রাসেল বলতেন যে, আগে আপনি খাবেন তারপর আমি বইপত্র নিয়ে বসব। মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের আতিথেয়তা গুণটি ছিল তার মাঝে।

এমন একজন মানবিক, বুদ্ধিমান, ধীরস্থির শিশুকে আমরা হারিয়েছি তার শৈশবেই।

তিন চাকার সাইকেল চালানোর প্রতি অনুরাগ ছিল রাসেলের। ছবি আঁকার প্রতিও ছিল তার গভীর আগ্রহ। বহুমুখী প্রতিভার শিশু ছিলেন রাসেল, যা ১০ বছর বয়সী বাচ্চাটির মাঝে সুপ্ত ছিল। ছোট্ট শিশু রাসেলের ছিল প্রখর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা।

বড় বোন শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘তখন প্রায়ই কবুতর খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সকালের নাশতার জন্য পরোটা ও কবুতরের মাংস ভুনা সবার প্রিয়। তাছাড়া কারও অসুখ হলে কবুতরের মাংসের ঝোল খাওয়ানো হতো। ছোট ছোট বাচ্চাদের কবুতরের স্যুপ করে খাওয়ালে রক্ত বেশি হবে, তাই বাচ্চাদের নিয়মিত কবুতরের স্যুপ খাওয়াত।’

‘রাসেলকে কবুতর দিলে কোনো দিন খেত না। এত ছোট বাচ্চা কীভাবে যে টের পেত কে জানে। ওকে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিলেও খেত না। মুখ ফিরিয়ে নিত। শত চেষ্টা করেও কোনো দিন কেউ ওকে কবুতরের মাংস খাওয়াতে পারেনি।’ বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ি ও গ্রামের বাড়িতে কবুতর পালন করা হতো। রাসেল নিজ হাতে মায়ের সঙ্গে কবুতরকে খাবার দিতেন। ছোট্ট শিশুটির মন কতটা সংবেদনশীল ও প্রাণির প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল, তা উপলব্ধি করা যায়।

পূর্ণবয়স্ক রাসেল যে কত বৃহৎ ও মহৎ প্রত্যাশিত জীবনকর্ম সম্পন্ন করার যোগ্যতা রাখতেন, বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জয়পতাকা উড়াতেন তা আমরা অনুভব করি। শিশুদের হত্যাকাণ্ড যে আমাদের ভবিষ্যতকে হত্যা করে, শিশুদের অপমৃত্যু যে আমাদের সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটায়, এ পঙ্কিলতা থেকে আমরা কবে মুক্ত হব?

রাসেল ১০ বছর বয়সেই যে সম্ভাবনা ও সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে গেছেন, তা আমাদের শিশুদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিশু রাসেলের জাপান সফরের উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত ছবিগুলো আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল অমলিন থাকবে।

আজকের এই দিনে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমরা শেখ রাসেলকে স্মরণ করছি ও প্রার্থনা করি, পৃথিবীর সব শিশু যেন নিরাপদে থাকে।

শ্রদ্ধা নিবেদন করি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টে শাহাদাতবরণকারী সব শহীদকে ও শ্রদ্ধা নিবেদন করি আমাদের চার জাতীয় নেতার স্মৃতির প্রতি যারা বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ধারণ করে আত্মোৎসর্গ করে গেছেন।

শেখ রাসেলের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১১৭ বছর আগে রচিতÑ ‘তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে যাও যে সরে’ পঙ্‌ক্তিমালা স্মরণে আসে।

বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক দেওয়ার ঘোষণার পর দিন ১১ অক্টোবর ১৯৭২ এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে নির্মোঘ আকাশের বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে শ্বেতকপোতেরা বিনা দ্বিধায় উড়ে বেড়াবে, যেদিন দুষ্ট বাজপাখি শ্বেতকপোতের ডানা ভাঙার জন্য ছোঁ মারবে না, সেদিন এ বিশ্বে নেমে আসবে শান্তির বারিধারা।’

শ্বেতকপোত রাসেলের জীবন সেদিনই নিরাপদ হবে। দুষ্ট বাজপাখিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বিশ্ববাসীকে সম্মিলিতভাবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১০

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১১

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১২

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৩

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৪

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৫

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৬

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৭

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৮

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

১৯

মাদকাসক্ত ছেলেকে কারাগারে দিলেন মা

২০
X