জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। রাজনীতির মাঠ সরগরম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। তাদের বক্তব্য শুনলে যে কারও মনে হতে পারে, দেশ ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে। ১৪ বছর ধরে যে সরকার দেশের এত উন্নয়ন করল, দেশটিকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে এলো সেই সরকারের যেন কোনো অর্জন নেই। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ ঢাকার সমাবেশ থেকে ১০ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ ২৭ দফা ঘোষণা করেছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে একযোগে বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য ও সহিংসতার প্রতিবাদে ‘শান্তি সমাবেশ’ করছে আওয়ামী লীগ। এমন সমাবেশে অশান্তি সৃষ্টির মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তারা বলেছেন, বিএনপি যতদিন আন্দোলন করবে, তাদের ‘শান্তি সমাবেশ’ ততদিন অব্যাহত থাকবে।
দেশের মানুষ চায় রাজনীতিটা প্রতিযোগিতামূলক হোক। রাজনীতিতে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুচিন্তার সমন্বয় ঘটুক। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা হলে রাজনীতিটা আরও বেশি সুন্দর ও স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে জনগণ ও দেশের কল্যাণে একটি সংঘবদ্ধ প্রয়াস। দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এর লক্ষ্য। রাজনীতিতে তাই বলা হয় ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। এ মূলমন্ত্র যদি আমরা অনুসরণ করি তাহলে দেশ ও জনগণের ক্ষতিসাধন করে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা, অগ্নিসন্ত্রাসের মতো ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমন রাজনীতি যে কোনো দলকে জনবিচ্ছিন্ন করে। তাই আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই কাম্য।
ফিরে দেখি দুই হাজার তেরো, চৌদ্দ, পনেরো সাল। কাচের বোতল, পেট্রোল, আর কিছু ভাঙা কাচ বা মার্বেলের টুকরো ব্যবহার করে অল্পতেই পেট্রোলবোমা তৈরি করে যাত্রীবাহী গাড়ি ও যানবাহনে ফেলত দুর্বৃত্তরা। এতে গাড়ি পুড়েছে, সঙ্গে পুড়েছে মানুষ। শুধু পেট্রোল বোমাই নয়, লাল বা কালো টেপে মোড়া ককটেলও ব্যবহার হয়েছে তখন। ককটেল তৈরিতে ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। সঙ্গে ছোট পেরেক, কাচের গুঁড়ো অথবা লোহার টুকরো। এ ছাড়া বোমা তৈরিতে গান পাউডারও ব্যবহার করা হতো। আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আন্দোলনের নামে তৎকালীন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসংযোগে নিহত হয় পাঁচশো নিরীহ মানুষ। আহত হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজারজন। আগুন সন্ত্রাসের শিকার হয়ে স্বামীহারা হয়েছে স্ত্রী, সন্তানহারা হয়েছে পিতা, পিতৃহারা হয়েছে পুত্র-কন্যা। দৈবক্রমে জীবিতদের আগুনে ঝলসানো শরীর দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে।
সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ’ অনুষ্ঠানে ভুক্তভোগীরা তাদের দুঃসহ জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার সালাউদ্দিন ভূঁইয়া সেদিনের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমি খুব সুন্দর ছিলাম, যেখানে চাকরির জন্য যেতাম, চাকরি হতো। এখন আমাকে দেখে কেউ কাজ দেয় না। আমার কাজ করার শক্তি আছে; কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। আমার পাশে কেউ বসে না। সবাই ভাবে আমি পাগল। আমার মনে অনেক কষ্ট।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ২০১৩ সালে পেশায় গাড়িচালক রমজান আলীর ছেলে মুনিরকে তার চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সন্তানহারা রমজান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো খেটে খাওয়া মানুষ। আমার চোখের সামনে আমার ছেলেকে আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর নেই।’ ২০১৩ সালে মাদারীপুর থেকে ঢাকা আসার পথে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১৭ বছরের কিশোর নাহিদ। তার মা রুনি বেগমও যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানকে দেখতে পারিনি, দেখার সুযোগ পাইনি বিএনপি-জামায়াতের কারণে।’ সন্তানহারা এ মা আর্তনাদ করে বলেন, ‘সন্তান হত্যার বিচার পাইনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমার সন্তান হত্যার বিচার আপনি করবেন।’ ট্রাক ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম ঢাকা থেকে মালপত্র নিয়ে ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে দিনাজপুরের কাহারুল থানার ভাদগাঁওয়ে পেট্রোল বোমার শিকার হন। পুড়ে যায় তার শরীর। মৃত্যুগহ্বর থেকে বেঁচে ফিরলেও সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ক্ষত। ফটোসাংবাদিক আবু সাঈদ তামান্না স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেদিন আমি মৃত্যুর মুখে পড়ে যাই। আমার কাছে একটা ফোন আসে যে দুষ্কৃতকারীরা পেট্রোলবোমা বিতরণ করছে। দুর্বৃত্তরা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তাড়া করে ছুরিকাঘাত করে।
রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলায় কাঁচপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন বিজিবির সুবেদার নায়ক শাহ আলম। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, যতদিন বেঁচে থাকব, এই যন্ত্রণা কখনো ভুলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে স্বামীহারা এ নারী বলেন, ‘আমার স্বামী তো রাজনীতি করেনি। তার তো কোনো অপরাধ ছিল না। সে তো দেশের কাজে নিয়োজিত। তাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো?’ ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাহেববাজারে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বোমায় সাব-ইন্সপেক্টর মকবুল হোসেনের দুটি হাত উড়ে যায়। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। মকবুল বলেন, পুলিশের সদস্য হিসেবে গর্বিত। মানুষের সেবায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করি না। আমি আহত হয়েছি, পঙ্গুত্ববরণ করেছি; কিন্তু মনোবল হারাইনি। ওই সময় পুলিশ কনস্টেবল জাকারিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরিন বলেন, ‘২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত। আমি এখনো সেই যন্ত্রণা নিয়ে চলছি। আমাদের সবার আকুতি, জামায়াত-বিএনপির নৈরাজ্যের বিচার চাই।’
রাজনীতিতে যদি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ক্ষমতার লিপ্সা মুখ্য হয়ে দেখা দেয় তবে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যে নিপতিত হয় দেশ। নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশের বাতাস। রাজনীতিবিদদের সবসময় হতে হবে প্রজ্ঞাবান, ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী। দেশের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, “অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনোদিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।”
আওয়ামী লীগ সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তে অগ্নিসন্ত্রাস অনেকটাই দমন করা গেছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও সরব হয়ে উঠছে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা। এরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ এবার অভিনব পন্থা বেছে নিয়েছে। নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শান্তি সমাবেশ করছে দলটি। যা জনগণের জানমাল সুরক্ষার অহিংস প্রয়াসের অনন্য এক দৃষ্টান্ত।
লেখক : উপাচার্য চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়