শংকর মৈত্র
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৩০ এএম
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চিকিৎসাব্যবস্থা কোন পথে

চিকিৎসাব্যবস্থা কোন পথে

আমার এক নিকটাত্মীয় অসুস্থ হলে ঢাকার বিশেষজ্ঞ এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগী দেখানোর জন্য সিরিয়াল দেওয়া হয় এবং জানানো হয় নির্ধারিত দিনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় যেতে হবে। ঠিক সময়ে রোগী নিয়ে হাজির। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসলেন ৮টার পর। ততক্ষণে রোগীর ভিড় লেগে গেছে। চেম্বারে বসে চিকিৎসক আরও অন্তত ১৫ মিনিট রেস্ট নিলেন। তারপর রোগী দেখা শুরু করলেন। আমার সিরিয়াল বেশ আগে ছিল। সাড়ে ৮টার পর আমি ঢুকলাম। পরিচয় পর্ব সেরে বললাম, দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি। বাইরে এত রোগী। (সহকারীর কাছ থেকে জানলাম ৬০ জন রোগী, এর মধ্যে ৪০ জন নতুন আর ২০ জন পুরোনো)। সারা রাত তো লেগে যাবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বললেন, কী করব বলুন। আমাদেরও তো ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবন আছে। বললাম, তাহলে রোগীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলুন। ২০ জন দেখুন। আপনার চাপ কমবে। মনে হলো তিনি এ পরামর্শ খুব একটা ভালোভাবে নেননি। তিনি কথা না বাড়িয়ে আমার রোগী দেখলেন। ভালো করেই দেখলেন। ৫ থেকে ৭ মিনিট সময় নিলেন। যে চিকিৎসকের কথা বলছি, তিনি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ। ভিজিট এক হাজার টাকা। অথচ এ ধরনের স্নায়ুবিক রোগীকে ভালো করে দেখা, তার সবকিছু জানতে হলে ন্যূনতম ১০ মিনিট করে সময় দেওয়া দরকার। বাইরে বের হয়ে আমি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম দেখার জন্য, একজন রোগীর পেছনে কতক্ষণ সময় দেন একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। দেখলাম এক-একজন রোগী ঢুকছেন আর সর্বোচ্চ দুই মিনিটের মধ্যে বের হয়ে আসছেন। মনে হলো আমার রোগীকেই সর্বোচ্চ সময় দিয়েছেন। এর বেশি সময় দেওয়া ব্যস্ত চিকিৎসকের পক্ষে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ তিনি প্রতিদিন ৬০ জন রোগী দেখেন। একজনের পেছনে ১০ মিনিট সময় দিলে ৬০০ মিনিট সময় লাগবে। একনাগাড়ে দেখলে লাগবে ১০ ঘণ্টা। চিকিৎসক এসেছেন রাত সাড়ে ৮টায়। ১০ মিনিট করে সময় দিলে সব রোগী দেখতে ভোররাত হয়ে যাবে। শুনলাম তিনি ১১টার মধ্যে চলে যাবেন।

এই হলো আমাদের ব্যস্ত চিকিৎসকদের অবস্থা। এক হাজার টাকা ভিজিট নিয়ে একজন রোগীর পেছনে ২ মিনিট সময়ও ব্যয় করেন না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কমবেশি সবাই এমন ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন এত বেশিসংখ্যক রোগী দেখেন যে, কারও সঙ্গে ভালো করে কথাই বলা সম্ভব হয় না।

আরেকটি ঘটনা। আমার পরিচিত একজনের অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসক সব দেখেশুনে জানালেন, রোগী ক্যান্সার আক্রান্ত। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। এজন্য বাজেট দেওয়া হলো ৫০ লাখ টাকা। রোগীর পরিবারে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তার ওপর এত টাকা জোগাড় করা কঠিন। একজন পরামর্শ দিলেন ভারতে গিয়ে দেখানোর জন্য। সে অনুযায়ী ভিসা জোগাড় করে চেন্নাইয়ের সিএমসিতে গেলেন। সেখানকার চিকিৎসক সবকিছু দেখে জানালেন ক্যান্সার আছে, তবে সেটা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। ছোট্ট একটা অপারেশন করতে হবে। সেটাই করা হলো। সবকিছু মিলিয়ে তার খরচ হলো ১০ লাখ টাকা। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে তিনি দেশে এলেন। তাদের বক্তব্য, দেশে চিকিৎসা নিলে টাকাও যেত, মরতেও হতো।

কাঞ্চন কুমার দে। পেশায় সাংবাদিক। বয়স ৬২। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে গত বছর ২২ ডিসেম্বর দেশের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। এনজিওগ্রাম করে তার হার্টে পাঁচটি ব্লক পাওয়া যায়। ফলে দ্রুত ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর হাসপাতালটির একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট অ্যান্ড হেড অব কার্ডিও সার্জারি প্রফেসর তার ওপেন হার্ট সার্জারি করেন। টানা ছয় ঘণ্টা এ অপারেশন হয়। সাত দিন পর তাকে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করা হয়। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই আবার তার বুকে ব্যথা শুরু হয়। আবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এনজিওগ্রাম করালে দেখা যায়, তার দুটি ব্লক রয়েই গেছে। পরে তাকে দুটি ব্লকে রিং পরানো হয়েছে। সাংবাদিক কাঞ্চন কুমার দে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের কাছে বিচার চেয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছেন। ওপেন হার্ট সার্জারির পরও হার্টে দুটি ব্লক রেখে দেওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক। তিনি ডা. মাছুম সিরাজের বিচার চেয়েছেন। কিন্তু আদৌ এ ঘটনার কোনো বিচার হবে কি না, কিংবা কেউ দায়িত্ব স্বীকার করবেন কি না, এ নিয়ে সন্দিহান।

আরেকটি ঘটনা নিশ্চয়ই পাঠক ভুলে যাননি। রাজধানীর বেসরকারি সেন্ট্রাল হাসপাতালের। ভুল অপারেশনে নবজাতক ও পরে মায়ের মৃত্যু, যা নিয়ে তোলপাড় চলে সারা দেশে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে কিছুটা সরব হতে দেখা গেল। তারা হাসপাতালটি পরিদর্শন করে জানাল, সেখানে নিয়মনীতির অনেক কিছুই নেই। কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও শোনা গেল। তদন্ত কমিটি হলো। মামলা হলো। দুজন চিকিৎসক কারাগারে গেলেন। একজনের চিকিৎসা করার অনুমতি স্থগিত করা গেল। মিডিয়ায় যে কদিন খবর এলো, ততদিন আলোচনা থাকল। এরপর মিডিয়ায় খবর নেই, আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে হাসপাতালটি। আরও খবর হলো, যে চিকিৎসকের সনদ স্থগিত হলো, তিনি এখন অন্য আরেকটি হাসপাতালে দিব্যি রোগী দেখে যাচ্ছেন।

এই হলো আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার হালচাল। এ ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায়, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার চিত্র। কেন দলে দলে লোকজন চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ ভারতে চলে যায়? একটু সামর্থ্যবান যারা, তারা চলে যান থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে। উচ্চবিত্তরা যান যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ভারতে প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি শুধু চিকিৎসার জন্য যান। ভারতীয় চিকিৎসকদের তথ্যমতে, প্রতিবছর বিদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাংলাদেশি। ভারতীয় ভিসা সেন্টারে প্রতিদিন হাজারো মানুষের লাইন পড়ে ভিসার জন্য। এর অর্ধেকই থাকে মেডিকেল ভিসার আবেদন। কয়েক বছর ধরে থাইল্যান্ডমুখী হচ্ছেন বাংলাদেশি সামর্থ্যবান রোগীরা। পরিসংখ্যান বলছে, থাইল্যান্ডে বছরে অন্তত পাঁচ হাজার লোক যান চিকিৎসার জন্য। বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল, ভেজথানি হাসপাতাল, ব্যাংকক হাসপাতালে প্রচুর বাংলাদেশি চিকিৎসা করান। ভারতে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসার দরকার হলেও থাইল্যান্ডে পর্যটন ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা করানো যায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্যমতে, শুধু চিকিৎসার পেছনে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যায়। এর সিংহভাগই যায় ভারতে। বছরে বিভিন্ন দেশে যেসব বাংলাদেশি যান, তার ৬১ ভাগই যান ভারতে। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার এই বেহাল দশা কেন? স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেল, এখনো চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা এলো না কেন? অথচ দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বেড়েছে। দেশে এখন প্রায় প্রতি জেলাতেই একটি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ৩৭টি মেডিকেল কলেজ। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৯৮টি। আর সামরিক বাহিনী পরিচালিত মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৫টি। এ ছাড়া সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫টি। শুধু সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে প্রতিবছর চার হাজারের বেশি চিকিৎসক হয়ে বের হয়। আর বেসরকারি মেডিকেল থেকে বের হন সাড়ে সাত হাজার। সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল থেকে সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১২ হাজার চিকিৎসক বের হন। প্রতিবছর এত বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক বের হলেও চিকিৎসার গুণগত মান কেন বাড়ছে না, এটা বড় প্রশ্ন। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করেন—এমন লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা মনে করেন, আমাদের চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় গাফিলতি রোগীদের সময় না দেওয়া। আর গাদাগাদা টেস্ট। রোগীর সমস্যার কথা একচকিতে শুনেই কতগুলো টেস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। যত টেস্ট তত কমিশন। সব টেস্ট নিয়ে যাওয়ার পর দেওয়া হয় ১০ ধরনের ওষুধ। সেখানেও নাকি কমিশন থাকে। এ ছাড়া রোগীর সঙ্গে ভালো আচরণও করা হয় না। রোগীর সমস্যার কথা শোনা হয় না। অথচ বাইরের দেশ থেকে চিকিৎসা করে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সেখানকার চিকিৎসকরা কত ভালো ব্যবহার করেন ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেখেন। একজন রোগীর পেছনে অনেক সময় ব্যয় করেন। বলা হয় চিকিৎসাবিদ্যা সবচেয়ে মানবিকবিদ্যা এবং মানবসেবায় মগ্ন থাকেন চিকিৎসকরা। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকরা এর ধারেকাছেও নেই। তারা রোগীর স্বার্থের চেয়ে বেশি দেখেন ওষুধ কোম্পানির, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক হাসপাতালের কমিশনের বিষয়টি। আর চিকিৎসার খরচও বেশি। বিষয়টি নিয়ে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট যারা আছেন এবং চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংগঠনগুলোর ভাবা দরকার। চিকিৎসার জন্য যদি বছরে কয়েক হাজার কোটি

টাকা বাইরে চলে যায়, তাহলে এত মেডিকেল কলেজ করে লাভ কী? প্রতিবছর কয়েক হাজার চিকিৎসক হয়ে লাভ কী?

লেখক : সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমরা কোন ব্যর্থ নির্বাচন চাচ্ছি না : জামায়াত আমির

তোফাজ্জলের খুনিরা যেন রেহাই না পায় : লায়ন ফারুক

ফিলিস্তিন নিয়ে সমন্বয়ক সারজিসের স্ট্যাটাস

ভাইরাল সেই সাইনবোর্ড নিয়ে যা জানা গেল

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত

বৃষ্টি নিয়ে সুখবর

গণঅধিকার অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে খুঁটি হিসেবে কাজ করছে

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

‘ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতি হবে না’

ইসরায়েলকে ছাড় দিচ্ছে না প্রতিরোধ যোদ্ধারা

১০

কয়রায় গণঅধিকার পরিষদের আনন্দ মিছিল 

১১

অবশেষে কমলো সোনার দাম

১২

ভারতে টাইগার রবির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

১৩

যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড় হেলেনের ভয়াবহ তাণ্ডব

১৪

মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার নয় : আইজিপি

১৫

বৈরুতে বিপাকে বাংলাদেশিরা, দ্রুত সরে যাওয়ার পরামর্শ

১৬

বিএনপি জনগণের ভালোবাসার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় : নয়ন

১৭

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের’

১৮

আরব শেখদের লালসার শিকার ভারতের কুমারীরাও!

১৯

বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে গেল ৯৯ টন ইলিশ

২০
X