আলম রায়হান
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০২:৪৪ এএম
আপডেট : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৫৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আলুর দোষ এবং সাপলুডু

আলুর দোষ এবং সাপলুডু

দেশের নিত্যপণ্যের বাজার যেন সাগরের ঢেউ। একের পর এক, বিরামহীন। লাগাতার নিরন্তর প্রক্রিয়া। পণ্যমূল্য সাগরের বিরামহীন ঢেউয়ের মতো আঘাত হানে। এ যেন থামার নয়। এ ধারায় এখন চলছে আলুপর্ব। আর আলুর এ দোষ কাটাতে সংশ্লিষ্টরা ছোটাছুটি করছেন এদিক-ওদিক। এডাল-ওডালে দুরন্ত বাঁদরের মতো। এদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে গজেন্দ্র চালে চলা সরকার আলু-ডিম-পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। সবকিছু ছাড়িয়ে দেশে প্রধান আলোচ্য প্রসঙ্গ, আলুর দোষ। এমনকি আসন্ন নির্বাচনে প্রতীক হিসেবেও আলুকে বিবেচনায় নেওয়ার দাবি রাখে বলেও অনেকেই মনে করেন। আবার কারও কারও মতে, আগামী নির্বাচন নিয়েও আলুকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। আর এমনটা হলে রাজনীতিকদের বহু সাধের পিঠা চলে যেতে পারে মগডালে বসে থাকা বানরের হাতে!

ইতিহাস বলে, আলুর আদি জন্মভূমি লাতিন আমেরিকার আন্দেজ পার্বত্যাঞ্চল। খ্রিষ্টজন্মের পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি আগে আলুর চাষাবাদ শুরু হয়। পৃথিবীর বেশকটি দেশের প্রধান খাবার আলু। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের যে ‘গ্রেট আইরিশ ফ্যামিন’, সেই দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল ছত্রাক-আক্রান্ত হয়ে আলুর ফলন নষ্ট হওয়া। অষ্টাদশ শতকের বাভারিয়ার ক্ষমতা দখলের যে যুদ্ধ, তা ‘পটেটো ওয়ার’ হিসেবেই খ্যাত। আলু নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের একটি হচ্ছে ‘দ্য পটেটো ইটার্স। ভ্যান গগের আঁকা এ ছবিতে একটি পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে আলু খেতে দেখা যাচ্ছে। ইউরোপে আলু নিয়ে গান আছে। একটি-দুটি নয়, অনেক গান। আলু তাদের সংস্কৃতিতে আত্মীকৃত। শেরিল হুইলারের গানটি রীতিমতো বিখ্যাত, ‘পটেটো পটেটো পটেটো (৪-বার)/দে আর রেড, দে আর হোয়াইট, দে আর ব্রাউন/দে গেট দ্যাট ওয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড/দেয়ার ক্যানট বি মাচ টু ডু/সো নাউ দে হ্যাভ ব্লু ওয়ানস টুও।’ আরও গান আছে, আছে ছড়াগান। ছড়ার ছড়াছড়ি। মজাদার কৌতুক আছে। এদিকে আলু নিয়ে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় একটি পঙক্তি হচ্ছে—‘পা পিছলে আলুর দম।’ তবে কোনো আলুগীতি বা আলুসংগীত নেই। এদিকে বাংলাদেশে শুধু ‘আলুর দোষ’ বলে একটি কথা বেশ প্রচলিত। যার রূপান্তরিত চাপে সংশ্লিষ্টরা এখন গলদঘর্ম।

আলুর মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে সপ্তম স্থানে রয়েছে। যারা আন্তর্জাতিকমানের আলু গবেষক, তারাই বিস্মিত, এত কম পরিমাণ জমি এবং এত বেশিসংখ্যক মানুষের দেশে এত আলু কেমন করে উৎপাদন করে। বিশ্বের আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ স্থানে জার্মানি। এ দেশকে ছাড়িয়ে যেতে বাংলাদেশকে তেমন বেগ পাওয়ার কথা নয়। তবে জমির স্বল্পতার কারণে ওপরের তিন দেশ চীন, ভারত ও রাশিয়াকে ডিঙানো কার্যত অসম্ভব। ইউরোপের কেন্দ্রভূমি গ্রেট ব্রিটেনে আলুর মোট উৎপাদন ৫ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন টন আর বাংলাদেশে ১০ দশমিক ৩২ মিলিয়ন টন, প্রায় দ্বিগুণ। বেলজিয়ামের উৎপাদন বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ। ফ্রান্স একটু ভালো অবস্থানে আছে, তাতেও উৎপাদন বাংলাদেশের তিন ভাগের দুই ভাগ, স্পেন বাংলাদেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, ইতালি আট ভাগের এক ভাগ এবং বিশ্বে ইতালি ৩৭তম অবস্থানে। আলু কাহন এখানেই শেষ নয়, ২০০৫ সালে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই আইভানভ বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র আলু নয় যে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে নিয়ে লাগাবেন।’ আইভানভের কথাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্ধৃত করার মতো। তার কথাটি তখন ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য, রাশিয়া আলুভক্ত দেশ। উৎপাদন তালিকায় তৃতীয় শীর্ষস্থানে। হরেকরকম আলু-খাবার ছাড়াও রাশিয়ায় আলুর একটি বিশেষ ব্যবহার ভদকা তৈরিতে। রুশরা যে গ্যালন গ্যালন ভদকা খায়—এটিকে বরং এভাবে বলা যায় যে, তারা আসলে গ্যালন গ্যালন আলুর জুস খায়।

আলুর গুণ অন্তহীন। সবচেয়ে ভারসাম্য রক্ষাকারী খাবার। সবচেয়ে কম জায়গায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ক্যালরির জোগান দিতে পারে আলু। পুরুষ এটি জানে বলেই নারীর চেয়ে গড়পড়তা বেশি আলু খায়। তারপরও বাংলা অভিধান লিখেছে, ‘আলুর দোষ।’ মানে নারীর প্রতি পুরুষের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। অবশ্য অন্য এক আসক্তিকেও এভাবে আখ্যায়িত করা হয়। আমাদের দেশে বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছে। আলুর দাম বেঁধে দিয়েছে। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের অন্য কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। আলুর মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ না খুঁজে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীদের পেছনে ছুটে যে ফায়দা হওয়ার নয়, এটি নিশ্চয়ই এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এদিকে বাজারে দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বর্তমানে হিমাগারগুলোতে যে পরিমাণে আলু রয়েছে, তার প্রায় ৪০ ভাগ কৃষকদের, বাকিটা মজুতদার-আড়তদারদের। আবার কৃষকের আলুর ১৫ শতাংশ বীজ আলু। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রি করলে হিমাগার পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকার মতো অতিরিক্ত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবেন। বিষয়টি তারা মানতে পারছেন না। সরকার বর্তমানে হিমাগারে থাকা আলু নিলাম করার কথাও বলেছে। কিন্তু নিলাম করলে সেই আলু তো মজুতদার-আড়তদাররাই কিনবেন। এদিকে সদাশয় সরকার আলু আমদানির কথাও বলছেন। আমদানি করলে দাম হয়তো কমে আসবে। তবে তাতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। পাশাপাশি ভেঙে যাবে সনাতনী সরবরাহ চেইন। সে ক্ষেত্রে তারা আলুর ব্যবসা থেকে সরে এলে এবং কৃষকরা আলু উৎপাদন কমিয়ে দিলে অন্য রকম সংকট তৈরি হবে। এদিকে অনেকে মনে করেন, সরকার বছরের শুরুতে আলু কিনে ক্রমান্বয়ে বাজারে ছাড়লে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকত। দেশে উৎপাদিত অতিরিক্ত আলু বিগত বছরগুলোতে চাষি এবং ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াত। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, বর্তমানে দেশের হিমাগারগুলোতে যে পরিমাণ আলু আছে, তা দিয়ে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভালোভাবে চলার কথা। এর মধ্যেই বাজারে নতুন আলু উঠে যাবে। ফলে ঘাটতির কোনো কারণই নেই। খোদ বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ পরিমাণ ১ কোটি ১২ লাখ টন। দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। বোঝাই যাচ্ছে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। সংবাদ সম্মেলন করে হিমাগার মালিকদের সংগঠন অভিযোগ করেছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে আলুর দাম বাড়াচ্ছেন। তাহলে কি আমজনতা ধরে নিতে বাধ্য হবে, সরকার পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ডিম, আলু এমনকি ডাবের মতো প্রায় সব খাদ্যপণ্যের বিক্রেতা সিন্ডিকেটের প্রতি সহানুভূতিশীল? নাকি অংশীজন! তাই একেক সময় একেক পক্ষকে সুযোগ করে দিচ্ছে? নাকি ‘বগলে ইট, মুখে শেখ ফরিদ’ অবস্থায় আছে সরকার? এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংসদে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তা তো অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সবসময় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে বাংলাদেশকে ভুগতে হচ্ছে। এ বয়ান শুনতে শুনতে আমরা হয়রান। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও বলেছে, বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের সূচক গত আগস্টে দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। কারণ চাল ও চিনির দাম বাড়লেও এর আগের মাসে বেশিরভাগ খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কমে যায়। এফএও বলছে, ভারতের রপ্তানি বিধিনিষেধের পর চালের দাম ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়া সত্ত্বেও সামগ্রিক সূচকে দুগ্ধজাত পণ্য, তেল, মাংস ও খাদ্যশস্যের দাম কমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেছেন, ‘সাপের খেলা যে জানে, সে ঠিকই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’ তাহলে কি দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকার আমজনতার সঙ্গে সাপলুডু খেলছে!

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় নাটোরবাসীর মিলনমেলা শুক্রবার

সোনারগাঁয়ে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

১০

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১১

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১২

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১৩

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

১৪

চীন যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, হবে যেসব আলোচনা

১৫

শৈশবের বন্ধুদের প্রিয় কবিতা শোনালেন মির্জা ফখরুল

১৬

পুতুল-টিউলিপসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

১৭

পুতুলকে ‘হু’ থেকে অপসারণে অনলাইনে চলছে গণস্বাক্ষর, ব্যাপক সাড়া

১৮

চটপটির দোকানে ২৩৪ কোটি টাকা ঋণ, অনুসন্ধান করবে দুদক

১৯

ভুয়া আসামি দাঁড় করিয়ে জামিন, ৪ জনের নামে মামলার নির্দেশ আদালতের

২০
X