বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ আজ ৭৪ বছরে পা রাখলেন। একাত্তরের রণাঙ্গনের সাহসী এ যোদ্ধা তার শিল্পকর্মে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে বারবার এঁকেছেন। তার ছবির নিজস্ব একটি ভাষা আছে। তিনি সত্তরের দশকের বিমূর্ত চিত্রকলার দুর্বোধ্য পর্বকে অবলোকন করেছেন ঠিকই, কিন্তু এ ধারার সঙ্গে একীভূত হননি। বরং তিনি সংগ্রামী মানুষের ছবি আঁকতে গিয়ে স্বকীয় শৈলীতে অপ্রতিরোধ্য গতির ইঙ্গিতময় অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে বরেণ্য শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শাহরিয়ার মাহমুদ প্রিন্স-
কালবেলা : আপনি তো মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরে ছিলেন, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঠিক কোন এলাকায় ছিল?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমি ট্রেনিং নিই আগরতলার মেলাঘরে। তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে আমাদের ট্রেনিং হয়েছিল। খালেদ ভাইয়ের সেক্টর ছিল ২ নম্বর। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে এ ২ নম্বর সেক্টরটি বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। কেননা ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল ঢাকা-কুমিল্লা। ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা লালবাগ ও ধানমন্ডির দায়িত্বে আমি ছিলাম প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে।
কালবেলা : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : আমাদের ট্রেনিং হয়েছিল মেলাঘরে। আমাদের ট্রেনিং হতো দিনে দু’দফা। প্রথমে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। আবার দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। খালেদ ভাইয়ের কাছেই ট্রেনিং নিয়েছি। তিনি ছিলেন দুঃসাহসী যোদ্ধা। ট্রেনিং শেষে ঢাকায় ফিরলাম। আমি বেছে নিলাম ঢাকার পেছনের আটি, বসিলা এলাকা। আমি আটি, বসিলা, ভাওয়াল, খোলামোড়া এলাকাগুলো ভালো চিনতাম। এসব এলাকা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধ কোনোটাই সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু মনোবল ছিল দৃঢ়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার ইস্পাতসম অঙ্গীকার নিয়েই শতকষ্টকে তুচ্ছ ভেবে যুদ্ধ করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন যে কত আনন্দের, কত ত্যাগের এটা তোমাদের বোঝানোর মতো ভাষা আমার জানা নেই। পরানের গহিনে এ অনুভূতি থাকে। একে প্রকাশ করা অত সহজ না মিয়া!
কালবেলা : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার একটা চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল মেলাঘরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। আসলে ঘটনাটা কী ছিল?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : প্রশিক্ষণের মধ্যেই একদিন জঙ্গলে বসে বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেট এঁকেছিলাম। আমার এ ছবি আঁকার খবর রটে যায়। শওকত ভাই (আওয়ামী লীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী) আমাকে ডেকে ২১ টাকা দেন হাতে। বলেন, ‘আগরতলা থেকে রংতুলি কিনে আনো। তুমি আঁকার কাজটা থামিও না।’ আমি ছুটি নিয়ে আগরতলায় গেলাম, আমার হাতে ২১ টাকা। সেখানে কিছু পুরোনো ক্যালেন্ডার পেলাম। সঙ্গে চোখে দেওয়ার কাজল, আইব্রো পেনসিল, আলতা কিনে আনলাম। ক্যালেন্ডারের উল্টো দিকে কিছু ছবি আঁকলাম। বেশ কিছু ছবি এঁকে ফেলার পর শওকত ভাই উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘আমরা একটা কিছুর আয়োজন করব। সে সময় তোমার ছবিগুলোও সবাইকে দেখাতে পারব।’
আমি ছিলাম ১৭ নম্বর প্লাটুনে। সংগীতশিল্পী আজম খান তখন ১৩ নম্বর প্লাটুনে। ঠিক হলো, আমার ছবির প্রদর্শনীর পাশাপাশি আজম খানের গানের অনুষ্ঠান হবে। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে পরিকল্পনাটা জানানো হলো। তিনি সানন্দে অনুমতি দিলেন। সে কী উৎসাহ আমাদের! আমরা জঙ্গলের ভেতরেই গাছে রশি বেঁধে ঘরের মতো তৈরি করলাম। জাম্বুরাগাছের কাঁটা দিয়ে সে ঘরের দেয়ালে টানানো হলো আমার ১২টি ছবি। আগরতলা থেকে হারমোনিয়াম এলো। আজম খান সেদিন ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি গেয়েছিলেন। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার এখনো মনে আছে, আমার ওই প্রদর্শনীতে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান। সেদিন খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল।
কালবেলা : এখানেই জাতীয় নেতা এবং মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ? তিনি সাহিত্য-শিল্পরসিক ছিলেন। কবিতাও লিখতেন শুনেছি।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : হু, এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনা ভাইয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক পরিচয় এখানেই হয়। তবে নেতা হিসেবে তাকে সেই ষাট দশক থেকেই চিনতাম। ভীষণ সরল মানুষ ছিলেন হেনা ভাই আর তার মধ্যে একটা শিল্পিত মানুষ বাস করত। দেখো না, তার ছেলে লিটন কেমন হয়েছে? লিটন কি শুধুই রাজশাহীর মেয়র? না, সে রাজশাহী ‘নগরের শিল্পী’। রাজশাহীকে লিটন শিল্পীর চোখ দিয়ে সজ্জিত করেছে। আমার খুব ভালো লেগেছে রাজশাহী শহর।
কালবেলা : সালদা নদীর যুদ্ধে কীভাবে যুক্ত হলেন?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : আমরা জোরদার ট্রেনিং নিয়েছিলাম, কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত অস্ত্র আমাদের ছিল না। তাই মাঝেমধ্যে আমরা অস্থির হয়ে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইতাম। অবশেষে একদিন সেক্টর কমান্ডার বললেন, ‘সালদা নদীতে গিয়ে যুদ্ধ করে দেখিয়ে দাও, কী করতে পারো!’
সেদিন আমাদের হাতে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। দিনটি ছিল ১৪ আগস্ট—পাকিস্তান দিবস। সালদা নদীর রেলস্টেশনে ছিল পাকিস্তানিদের ঘাঁটি। আমরা সীমান্ত পার হয়ে এসেছিলাম। নিজের দেশে এসেছি, ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মনে আছে, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে নদী সাঁতরে আমরা এসেছিলাম। রাত আড়াইটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা আক্রমণ করেছিলাম। সেটা ছিল সফল আক্রমণ। এলাকাটি আমরা দখল করে নিয়েছিলাম।
কালবেলা : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ যেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে সেদিন আপনি শাহবাগে অবস্থিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও স্টেশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন এবং এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন। ঘটনাটি কি খুলে বলবেন?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ সকাল ৯টায় আমিই স্লোগান ধরলাম—‘জয় বাংলা’। যাব হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। আমি তখন জানতাম না সেটা নিউট্রাল এরিয়া। যখন স্লোগান দিলাম, তখন ছিলাম আমরা ছয়জন। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে শত শত লোক এসে পড়ল। বুড়ো-বুড়ি, কাজের লোকই বেশি। হঠাৎ দেখি পাঁচশ-ছয়শ লোক হয়ে গেল। গ্রিন রোডে যাওয়ার পর ১০-১২ হাজার। ২০-২২ হাজার লোক নিয়ে এগিয়ে গেলাম শাহবাগে। ওরা সবাই ভেবেছে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিদেশি সাংবাদিকরা আমাদের কাছে এগিয়ে এলো। ভয়ের কথা জানাল। আমরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম মাত্র ছয়জন। আমি ওদের কাছে মিথ্যা বললাম। বললাম আমরা হাজার হাজার আছি। সবাই ড্রেনের ভেতর পজিশন নিয়ে আছে। ভয়েস অব আমেরিকা সেই নিউজ দিয়ে দিয়েছে। কথাটা কাজে লেগে গেল। এ খবর শুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা মোরালভাবে ডাউন হয়ে যায়। শাহবাগ এলাকা তখন জনসমুদ্র। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত। আমি বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে গিয়ে ‘আই অ্যাম অ্যাগেরিলা প্লাটুন কমান্ডার শাহাবুদ্দিন, উই কন্ট্রোল এভরিথিং’—এসব বলতেছি। ওরা বিশ্বাস করল না। বলল এসব মিথ্যা কথা। হঠাৎ দেখি পাশেই রেডিও অফিসে পাকিস্তানি পতাকা। একজন জনসমুদ্রের মধ্য থেকে লাঠিতে আমাদের ম্যাপ আঁকা পতাকা এনে দিল। আমরা পতাকা নিয়ে রেডিও অফিসের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি গেট তালা মারা। দেয়াল টপকে পতাকা লাগাতে গিয়ে দেখি ভেতরে কয়েকশ পাকিস্তানি সোলজার। আমি বের হয়ে গেলাম। বাইরে স্লোগান—জয় বাংলা, দেশ স্বাধীন। আমাকে দেখে এক অফিসার বলে উঠল, ‘ঘাবরাও মাত, ঘাবরাও মাত’। অনেকে সাদা রুমাল দেখাতে লাগল। এই চান্সে আবার ভালো করে ওঠালাম। দেয়ালে তারকাঁটা ছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের এক কর্মচারী বলল, স্যার, কী করে রেডিওর ছাদে যেতে হয় আমি সে রাস্তাটি চিনি। আমরা দুজন লাফ দিয়ে ভেতরে পড়লাম। ফ্লাগটা হাতে নিয়ে এগোতে লাগলাম। পাকিস্তানি সৈন্যপ্রধান ভয় পেয়ে গেল, উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে বলতে লাগল—‘স্বাধীন, ঘাবরাও মাত, ফ্লাগ চেঞ্জ, ওকে’। ডেডলাইন অব বাংলাদেশ ডকুমেন্টারিতে সবই আছে। তুমি তো দেখছ?
কালবেলা : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার বাবার ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু আপনার সঙ্গে সখ্য হলো কীভাবে?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখেছি পল্টনে সমাবেশে। দেখেছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দূর থেকে। স্বাধীনতার পর দেখি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আমরা ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা ঘোষণা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধু ফেরত না এলে অস্ত্র জমা দেব না, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর হাতেই অস্ত্র জমা দেব। ১৯৭২ সালের ২১ বা ২২ জানুয়ারি অস্ত্র জমা দিলাম। তৎকালীন রমনায় রজনীগন্ধায় বঙ্গবন্ধু সেখানে অফিস করতেন। আমরা অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে এক-একজন পরিচয় দিয়ে অস্ত্র জমা দিচ্ছি। যখন আমার পরিচয়পর্ব এলো, তখন তিনি বললেন, বাবা কীসে পড়ো। বললাম, জয়নাল আবেদিন সাহেবের আর্ট কলেজে। তিনি অবাক হলেন। তিনি এমনভাবে তাকালেন, মনে হলো গর্বে তিনি ফুলে উঠেছেন। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় পড়ো? বললাম আর্ট কলেজে। তুমি ছবি আঁকো, তুমি যুদ্ধ করেছ। বললাম, জি। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি ছবি দেখতে চাই। তুমি ছবি দেখাবে আমাকে। আমি বললাম, ছবি দেখবেন? তিনি আমার গালে ধরে আদর করে বললেন, হুম দেখব। আমি আশ্চর্য হলাম। আমি বিস্মিত হলাম। মনে হলো, আমি তার সন্তান। পিতাসুলভ ভালোবাসা দেখালেন। পরে ছবি নিয়ে যাই বঙ্গবন্ধুকে দেখানোর জন্য। ১৯৭৩ সালে ক্যাবিনেট মিটিং চলছিল। সেখানে আমার আঁকা ‘প্রিজনার’ ছবি নিয়ে হাজির হই। বঙ্গবন্ধু ধূমপান করতেন। তিনি তখন পাইপ রেডি করছিলেন। ছবিটি দেখে বললেন, ‘আমি ছবি খুব ভালো বুঝি না। কিন্তু ছবিটা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারাজীবন তো জেলেই কাটালাম।’ ৮ ফুট বাই ৪ ছবিটি অনেক বড় ছিল। রুমে প্রবেশের সময় আটকে যাচ্ছিল।
১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ শেষ করলাম। সে সময় আমি চারুকলা ছাত্র সংসদের সহসভাপতি মানে ভিপি ছিলাম। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রিয় ছাত্র আমি। বঙ্গবন্ধু আবেদিন স্যারকে খুবই সম্মান করতেন। আমার রাজনৈতিক পরিচয়টাও বঙ্গবন্ধু জানতেন। একসময় তিনি জানলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং তার ঘনিষ্ঠ সহচর তায়েব উদ্দিন আহমেদের সন্তান আমি। আমার ছবি আঁকার ক্ষেত্র নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা অসামান্য। বঙ্গবন্ধু বললেন, প্যারিসে যাবি, পিকাসোকে মার (টেক্কা) দিবি। এ কথাগুলো বলার পর বাঘের মতো শক্তি পেলাম।
কালবেলা : ১৫ আগস্ট আপনি ফ্রান্সে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর কখন বা কার কাছে শুনলেন? সেই দিনটির কথা কিছু বলুন।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : আমি তখন ফ্রান্সে। প্রথমে শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। সেদিন আমি একটা সৈকতে বসে আছি। ফ্রান্সে আমার এক ফরাসি আন্টি ছিলেন, তন্ত ইবন। আন্টি নামেই ডাকতাম তাকে। সেই আন্টি সেদিন দৌড়ে এসে আমাকে বলছিলেন, শাহাবুদ্দিন, তোর সঙ্গে যে একটা লোকের ছবি দেখেছিলাম, লম্বা-চওড়া হ্যান্ডসাম একটা লোক—একটু আগে তাকে দেখিয়েছে টিভিতে। তোদের দেশে কী যেন একটা হয়েছে! কী যেন একটা সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। আমি বললাম, বাংলাদেশে আবার কী হবে! ধুর তুমি কী দেখেছ না দেখেছ! আন্টি নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না। কিন্তু আধঘণ্টা পর আন্টির বোন ফোন করে একই কথা বললেন। বললেন, ঢাকার রাস্তায় নাকি সৈন্য দেখা গেছে। কী যেন একটা হয়েছে। পরের দিন ভোরবেলা টিভির সামনে বসে আছি। হঠাৎ দেখলাম—বলছে, ‘ইন বাংলাদেশ, দ্য টাইগার অব দ্য স্টেট ওয়াজ কিল্ড।’ আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। যে মানুষ দেশের মানুষকে এত ভালোবাসতেন, সে মানুষকে দেশের ভেতরেই এভাবে হত্যার শিকার হতে হবে!
কালবেলা : বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবক্ষয়ের জন্ম হলো, সেটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের সূচনা হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল ঘাতকচক্র। এরপর ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে আপনজন হিসেবে পরিচিত এবং তার বিশ্বস্ত সহচর জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় অন্তরীণ অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই কিন্তু ঘাতকদের নৃশংসতা ও যড়যন্ত্র শেষ হয়নি। ঘাতকরা ২১টা বছর ধরে ধ্বংস করেছে। যে জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার সম্পূর্ণ উল্টো দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তারা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতাটাই বই থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ওরা। এখন সেই পাতাগুলো খুঁজে খুঁজে এনে জোড়া লাগাতে হচ্ছে, আঠা লাগাতে হচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে, বাঁধাই করতে হবে। আবার সেটা শুকাতেও সময় লাগবে। এখন সেই চেষ্টাই চলছে।
কালবেলা : আপনার কি মনে হয় বারবার মানুষ জেগে উঠবে এবং ষড়যন্ত্র রুখে দেবে?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : নিশ্চয়ই! শাহবাগ যদি না হতো, তাহলে তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা করা ততটা সহজ হতো না। তোমরা যখন শাহবাগে আন্দোলন করেছ তখন কিন্তু প্যারিসে আইফেল টাওয়ারের নিচে আমরা বাঙালিরা একত্রিত হয়ে একাত্মতা জানিয়েছি। এত বছর পর প্রথমবারের মতো সেখানে বাঙালিদের এত বড় একটা সমাবেশ আমরা আয়োজন করতে পেরেছিলাম। আমরা তখন তোমাদের নিয়ে গর্ব করেছি। একটা স্পিরিট তো আছেই, এটা রক্তের মধ্যে মিশে আছে। তোমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, কিন্তু তোমরা এখন আস্তে আস্তে বিষয়গুলো বুঝতে পারছ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্য জানান দেয়।
কালবেলা : আপনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। কিন্তু আপনি কি মনে করেন ‘জয় বাংলা’ সার্বজনীন স্লোগান?
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ : ‘জয় বাংলা’র সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত। যুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে এমন কেউ নেই যে জয় বাংলা বলেননি। জয় বাংলা স্লোগানই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এবং স্বাধীনতাকামী লাখ লাখ মানুষের মধ্যে লড়াই করার সাহস দিয়েছে। আমি, আমরা সবাই সাহসী হয়েছি—জাগ্রত হয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, হাজারও কষ্ট সহ্য করেছি সব কিন্তু জয় বাংলার প্রেরণায়। এ জন্য জয় বাংলাকে আমি সার্বজনীন স্লোগান মনে করি এবং এ স্লোগানই ছিল আমার শিল্পীসত্তার মূলমন্ত্র।
মন্তব্য করুন