সকাল হইতেই কৃষ্ণনগরের বাসিন্দারা দেওয়ালে দেওয়ালে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখিয়া যুগপৎ বিস্মিত এবং চিন্তিত হইয়া পড়িল। বিজ্ঞপ্তিটি একটি নিখোঁজ সংবাদ। কৃষ্ণনগরবাসী দলবদ্ধভাবে বারবার পাঠ করিতেছে। সংবাদটি নিম্নরূপ :
নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি—
এতদ্বারা সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, কৃষ্ণনগরের অত্যন্ত পরিচিত মুখ শ্রী গোপালচন্দ্র ভাঁড় বিগত দুই সপ্তাহ যাবৎ নিরুদ্দিষ্ট হইয়া রহিয়াছেন। তাঁহার দেহের বিবরণ হইল—তিনি অতিশয় স্থূলকায়, মধ্যপ্রদেশ অর্থাৎ উদর অনাবশ্যক স্ফীত, কেশ বিরল অথচ বাবরিসম্বলিত মাথা, গাত্র কিঞ্চিৎ শ্যামবর্ণ, মুখমণ্ডল গোলাকার, চক্ষুদ্বয় রসগোল্লার মতো এবং প্রায়শই রক্তবর্ণ রূপ ধারণ করে, পরিধানে লালরঙের ধুতি ও হলুদ রঙের ফতুয়া এবং স্কন্ধে একটি গামছা, বয়স চল্লিশ হইতে ষাটের মধ্যে। কথাবার্তা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং পেশায় নরসুন্দর। যদি কোনো সহৃদয় ব্যক্তি এই নিরুদিষ্ট মানুষের হার সন্ধান পান অথবা কোথাও দেখিয়া থাকেন, তাহা হইলে অতিসত্বর নিম্নবর্ণিত ঠিকানায় যোগাযোগ করিবেন এবং সন্ধানদাতাকে উপযুক্ত পরিমাণ পারিতোষিক প্রদান করা হইবে।
সন্ধানপ্রার্থী : ভারপ্রাপ্ত মহারাজ গবুচন্দ্র সিংহ রায় (সাবেক মন্ত্রী, কৃষ্ণনগর, ভারতবর্ষ)।
কৃষ্ণনগরের সর্বত্র এই বিজ্ঞপ্তি সাঁটিয়া দেওয়া হইল এবং উৎসুক কৃষ্ণনগরবাসী হুমড়ি খাইয়া এই সংবাদ পাঠ করিতে থাকিল। ইহার ফলে সর্বত্র বিষাদের ছায়া পড়িল। শুরু হইল ব্যাপক গুঞ্জন। কেহ কেহ এমন মন্তব্যও করিল যে, গোপাল ভাঁড় মন্ত্রীর চক্ষুশূল হওয়ায় সে কটা-ঘটার সঙ্গে গোপন শলাপরামর্শ করিয়া গোপালকে গুম করিয়া দিয়াছে।
দুই দিন না যাইতেই আবার নূতন হারানো বিজ্ঞপ্তি। এবার নিখোঁজ কৃষ্ণনগরের প্রবীণ নাগরিক অতিশয় মৃদুভাষী এবং নম্রস্বভাবের বিজ্ঞানী। আবার নাগরিকদের জটলা, কানাকানি এবং সংশয়। বিজ্ঞানীর মতো এমন নিরীহ মানুষ হঠাৎ উধাও হয় কীভাবে? কৃষ্ণনগরবাসী কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছে না এমন অজাতশত্রু একজন বিজ্ঞানসাধক কীভাবে নিরুদ্দেশ হইয়া যাইতে পারেন। এবারও সন্দেহ ঘনীভূত হইল এবং সন্দেহের তীর তাক করা হইল মন্ত্রীর দিকে।
ইহারও দুদিন পর অকস্মাৎ অন্তর্ধান ঘটিল কৃষ্ণনগরের মিষ্ঠভাষী প্রিয়দর্শন রাজকবির। এবার গোটা কৃষ্ণনগর জুড়িয়া চরম অসন্তোষ! এসব কী ঘটিতেছে এই শান্তিপূর্ণ রাজ্যে! একের পর এক ভালো মানুষ গুম হইয়া যাইতেছে! ওদিকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কোনো হদিশও পাওয়া যাইতেছে না।
এক রাত্রে মন্ত্রীর ভবনে মন্ত্রী এবং কটা-ঘটার গোপন সাক্ষাৎ—
মন্ত্রী— ব্যাপার কী রে কটা-ঘটা! মিঠু-বিটুরা কোথায়? ওদের কাজ কতদূর?
কটা—একটু সময় তো লাগবেই মন্ত্রীমশাই! কতদূর যেতে হচ্ছে বুঝতে পারছেন! আর কীভাবে যাওয়া হচ্ছে তাও নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে।
মন্ত্রী—তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার তো আর দেরি সইছে না। কবে যে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকব, কবে যে সিংহাসনটায় বসব, তা তো বুঝতে পারছি না। ওদিকে মানুষজন তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে! আর হ্যাঁ, খুঁজে পেলি কোথায় গেছে বিজ্ঞানী আর রাজকবি? মানুষজন তো ভাবতে শুরু করেছে যে, আমিই নাকি চক্রান্ত করে একের পর এক ওদের গুম করে দিচ্ছি! গোপালের খোঁজ নেই, বিজ্ঞানীর খোঁজ নেই। এমনকি রাজকবিরও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না—এটা একটা কথা হলো!
ঘটা—মন্ত্রীমশাই, আমরাও তো বুঝতে পারছি সমস্যাটা, বনজঙ্গল থেকে শুরু করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। মনে হয় যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে মানুষগুলো।
কটা—মন্ত্রীমশাই, আরও কিছু মালকড়ি ছাড়ুন তাড়াতাড়ি। বিটু-মিঠুকে আরও দিতে হবে, আমাদের দুজনেরও লাগবে খরচপাতি। মাঝপথে তো থেমে গেলে হবে না।
মন্ত্রী—আরে না, না। মাঝপথে কেন থামবি! কাজ যখন শুরু করেছিস, তখন তো শেষ করতে হবেই।
ঘটা—তবে টাকা!
মন্ত্রী—দেব, দেব, যা আশা করেছিস তার চেয়ে বেশিই পাবি। আর তাছাড়া আমি যদি সিংহাসনে বসি তাহলে তোরা কোথায় উঠবি বুঝতে পারিস! একজন হবে মন্ত্রী আর একজন সেনাপতি, কী দারুণ!
কটা—সে যখন হবে তখন তো হবেই। কিন্তু এখন তো লাগবে আরও বেশ কিছু! দিন মন্ত্রীমশাই, তাড়াতাড়ি দিন। আমার তো আবার মিঠু-বিটুর সংসারেও কিছু পাঠাতে হবে।
মন্ত্রী—ঠিক ঠিক বলত তোরা, আর কদিন লাগতে পারে বলে মনে হয়?
ঘটা—মন্ত্রীমশাই, আপনি তো জানেন, কাজটা অনেক ঝুঁকির! ওরা দুজন কৃষ্ণনগরের শুধু নয়, গোটা মুর্শিদাবাদ খুঁজলেও ওরকম সিঁধেল চোর পাওয়া যাবে না। ওদের কাজ যেমন নিখুঁত, তেমনি পাকা। ওরা যখন কাজ শুরু করেছে তখন ভগবানের কৃপায় কাজ শেষ করেই আসবে। শুধু কাজ শেষ হওয়ার আগে গোপাল, বিজ্ঞানীরা যেন আবার দুম করে বেরিয়ে না পড়ে!
মন্ত্রী—ওরা কোথায় আছে সেই খবরটা যদি পাওয়া যেত, তাহলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। আচ্ছা, দেখা যাক! আমি তোদের জন্য কিছু টাকাকড়ি নিয়ে আসি।
কটা-ঘটা (সমস্বরে)—বেশি করে আনবেন কিন্তু মন্ত্রীমশাই। এ নিয়ে যেন বারবার প্যান প্যান না করতে হয়।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন