কৃষ্ণনগরের আকাশে কি দুর্যোগের ঘনঘটা? সপ্তাহাধিককাল অতিবাহিত হইল, কিন্তু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কোনো সন্ধান মিলিতেছে না, ওদিকে গোপালেরও কোনো খবর পাওয়া যাইতেছে না! এমনকি বিজ্ঞানী, রাজকবি, কবিরাজ মহাশয় এরা অনেকেই অনুপস্থিত। মন্ত্রী আর তাহার দুই চ্যালা কটা ও ঘটাও গোপালের সন্ধান করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি চালাইয়া যাইতেছে। ওদিকে আরেকটি সমস্যা হইল—মন্ত্রী এবং তাহার দলবল রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটক খোলার কোনো উপায়ও খুঁজিয়া পাইতেছে না। সেনাপতিকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করিতেও মন্ত্রীর হৃৎকম্প হয়। মহারাজ আর গোপাল ছাড়া ইদানীং সে কিছুই বুঝিতে চায় না। কটা একবার খুব নরম গলায় কথা বলিতে গিয়াছিল; কিন্তু সেনাপতি এমনই কটমট করিয়া তাহার দিকে চাহিয়াছিল যে, সে তড়িঘড়ি করিয়া ছুটিয়া পালাইয়াছে। প্রহরীদের কাছে যাইয়া যে অনুনয় বিনয় করিয়া ফটক খুলিতে বলিবে তাহারও কোনো সুযোগ নাই।
মন্ত্রী ব্যাকুল হইয়া ভাবিতেছে, এখন করণীয় কী হইবে! মুর্শিদাবাদের নবাব এবং দিল্লির বাদশাহের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তো এখন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পদত্যাগ করার কথা। ইহার পর মন্ত্রীই হইবে অন্তর্বর্তীকালীন রাজা। সে রাজ্য চালাইবে, খাজনা তুলিবে, আরও কয়েকজন অমাত্য এবং সভাসদের একটা কমিটি করিয়া নির্বাচনের আয়োজন করিবে—ইহাই তো ওপরমহলের নির্দেশ।
এই কয়েক দিন মন্ত্রী ঘরে বসিয়া অনেক ভাবনাচিন্তা করিয়াছে। কাহাদের লইয়া কমিটি গঠন করিতে হইবে তাহারও একটা ছক সঙ্গে সঙ্গে সাজাইয়া লইয়াছে। এ জন্য কমিটির প্রধান দুই সদস্য কটা ও ঘটাকে নিয়োগ করার কথা ভাবিয়াও রাখিয়াছে। ইহা ছাড়া সভাসদদের ভেতর হইতে এমন আরও তিনজনকে বাছাই করিতে হইবে যাহারা মন্ত্রীর কথার বাহিরে এক পাও বাড়াইবে না; কিন্তু এইসব পরিকল্পনা তো কল্পনাই থাকিয়া যাইবে যদি রাজসভায় প্রবেশ না করিতে পারে। আর যদি প্রহরীরা মূল সিংহদ্বার খুলিয়া না দেয়, একমাত্র গোপালের পক্ষেই সম্ভব এই অসাধ্য সাধন করা। বুদ্ধি দিয়া সে এমন উপায় নিশ্চয়ই বাহির করিতে পারিবে যাহাতে দরবারে প্রবেশের পথ সুগম হয় এবং মন্ত্রী খুব নিরীহ নিরীহ ভাব করিয়া দরবারে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। তাহা হইলে সে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনও শুরু করিতে পারে। অবশ্য সে মাথার মধ্যে একটা সরকার কাঠামো সাজাইয়াই রাখিয়াছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তাহার অতি প্রিয় এবং নানাবিধ কুকর্মের প্রধান বুদ্ধিদাতা হিসেবে পরিচিত ভগবানচন্দ্র দাশকে দাঁড় করাইতে হইবে। কটা-ঘটাকে তো কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে বসাইতেই হইবে। তাহাদের একজনের হাতে থাকিবে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব, অন্যজনের হাতে থাকিবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের খবরদারি। ওদিকে ভগবানচন্দ্র দাশকে নির্বাচন পরিচালনার ‘উপযোগী’ ‘নিরপেক্ষ’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য আইন প্রণয়ন দপ্তরের দায়িত্ব দিতে হইবে। তাহার ওপর দায়িত্ব থাকিবে নতুন ভোটার সংযোজন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং মন্ত্রীর ভাবাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত সংগঠন গড়িয়া তোলার ব্যবস্থা করা।
এই ছক অনুযায়ী যদি মুর্শিদাবাদ এবং দিল্লির ফরমায়েশের একটা নির্বাচন করিয়াই ফেলা যায়, তাহা হইলে তো মন্ত্রীর পোয়াবারো! কৃষ্ণনগরের সিংহাসনে উপবেশন এবং রাজত্ব কায়েমের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত! তখন কৃষ্ণচন্দ্রও নাই, গোপালও নাই, বিজ্ঞানী আর রাজকবিরও কোনো আসন থাকিবে না। তখন প্রথম সুযোগেই কৃষ্ণনগরের নাম গবুচন্দ্রনগর কিংবা মন্ত্রীনগর যাহাই হউক, একটা রাখা যাইবে। কিন্তু সবকিছুর আগে তো দরকার রাজসভায় প্রবেশ, সিংহাসন দখল, রাজপ্রাসাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। আর এ সবকিছুর জন্য দরকার ওই গোপালের হদিস। ওই এক গোপালকে যদি কোনোমতে বাগে আনা যায় তাহা হইলে তো সব সমস্যারই সমাধান হইয়া যায়। কিন্তু গোপালকে কোথায় পাওয়া যায়—কোথায় পাওয়া যায়!
এ সময়ই মন্ত্রীর বাসভবনে আসিল কটা-ঘটা।
মন্ত্রী—কী রে, তোরা কোথায় ঘুরঘুর করছিস? এর মধ্যে তো সাত-সাতটা দিন চলে গেল, সে খেয়াল আছে? এখানে এভাবেই কি সবসময় থাকতে হবে? রাজ্যপাট তো তাহলে উচ্ছন্নে যাবে দেখছি। আমার হয়েছে যত জ্বালা! একদিকে কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল, অন্যদিকে তোদের মতো অপদার্থরা! খোঁজ পেয়েছিস গোপালের? বিজ্ঞানী কিংবা রাজকবির কোনো খোঁজ পেলেও তো হয়! আমি তোদের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছি আর তোরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, তাই না!
—এসব কী বললেন মন্ত্রীমশাই! আমরা কি চুপচাপ গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াচ্ছি বলে আপনার মনে হচ্ছে? তাহলে আমরা এসব কাজ বাদ দেই আর আপনি যা পয়সাকড়ি দিয়েছেন সেসব ফেরত দিয়ে দেই।
—কী মুশকিল! এত রাগ করিস কেন? আমি তোদের কত ভালোবাসি, কত বিশ্বাস করি তা কি তোরা বুঝিস! আমি যে এদিকে চিন্তায় চিন্তায় একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছি, তা কি বুঝিস? আর তোরা দুজন তো আমার চোখের মণি রে। কোনোমতে যদি এই ফরমায়েশি নির্বাচনটা পার করতে পারি, তাহলে ওই কৃষ্ণচন্দ্র না কৃষ্ণকান্ত আর তোদের ওই মূর্খ গোপাল ভাঁড় আরও কে কে যেন—সেনাপতি না প্রজাপতি কিংবা ওই বুড়ো বিজ্ঞানী বা মিনমিনে কবি—এদের সবাইকে শূলে চড়াব! আগে তোরা খুব ঠান্ডা মাথায় আমার বুদ্ধিমতো কাজগুলো করে দে রে কটা-ঘটা!
—আচ্ছা, আচ্ছা! আপনি এত উতলা হবেন না, মন্ত্রীমশাই। আমরা একটা দারুণ ব্যবস্থা করে এনেছি আজ। সে জন্যই তো এখন আপনার কাছে এলাম। বেশ কিছু টাকাপয়সা লাগছে মন্ত্রীমশাই। এমনই ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছি যে, তিন-চার দিনের মধ্যেই আপনি প্রাসাদের ভেতরে ঢুকতে পারবেন, দরবারে প্রবেশ করে সিংহাসনে বসতেও পারবেন, মজার মজার খাবার—চপ-কাটলেট, রসগোল্লা, পান্তুয়া খেয়ে রাজত্বও চালাতে পারবেন। এখন শুধু কিছু অগ্রিম দিতে হবে আর কাজ শেষ হলে পুরোটা!
—বলিস কী রে কটা-ঘটা! সত্যি বলছিস! দেব, দেব, তোদের প্রাণ জুড়িয়ে দেব, বল বল কী করেছিস!
—না, না মন্ত্রীমশাই, আগে তো বলা যাবে না! প্রথমে মালকড়ি ছাড়ুন, তারপর! কথা আছে না, ফেলো কড়ি, মাখো তেল।
—আহা, বলেছি তো দেব। আমি তোদের ঠকাব না। আপাতত নে, এই ধর! কুড়ি হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
—না, না মন্ত্রীমশাই, স্বর্ণমুদ্রা নয়, নগদ টাকা চাই। এখন দুই লাখ আর কাজ শেষ হলে তিন লাখ। এর মধ্যে আবার এক তো চলে যাবে যাদের দিয়ে কাজটা করা হবে তাদের কাছে।
—এত টাকা! কোথায় পাব এখন এত টাকা!
—মন্ত্রীমশাই, এতদিন বিভিন্ন কাজে কমিশন নিয়ে নিয়ে বউয়ের গহনাগাটির ভান্ডার বানিয়েছেন, সেখান থেকে ছাড়ুন। আপনি সিংহাসনে বসলে তো সবই এক মাসের মধ্যেই উশুল করে ফেলতে পারবেন!
—উফ! এত বকিস না তো। দেব, দেব।
—আগে দিন। আর হ্যাঁ, কাজটা নামাবে দুজন। যাদের এখনই দিয়ে দিতে হবে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করে। ওটা হাতে গেলেই তবে ওরা কাজ ধরবে। অনেক ঝুঁকির কাজ মন্ত্রীমশাই, ঝক্কিরও কাজ।
—কোথায় ওরা?
—ওই তো পাঁচিলের ওপারে আছে। আচ্ছা, ওদের ডাকছি—ওরে মিঠু-বিটু তোরা সামনে আয়।
মন্ত্রী সবিস্ময়ে বলিল—
—সে কী, মিঠু-বিটু! ওরা! ওরা তো এখানকার নামকরা চোর!
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন