ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত বর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে অবিনশ্বর হয়ে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ভারতের শেষ ভাইসরয় (প্রশাসক) লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের (২৫ জুন ১৯০০-২৭ আগস্ট ১৯৭৯) নাম। ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ এবং ভারত ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের মতো ইতিহাসের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে ব্রিটিশ সরকার তাকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠায়। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিজেও বংশগতভাবে জমিদার ছিলেন। আত্মীয়তার সূত্রে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মামা। শিক্ষা জীবন শেষে তিনি রাজকীয় ব্রিটিশ নৌ বাহিনীতে যোগ দেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বহু নৌ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। এভাবেই তিনি নৌবাহিনীর উচ্চতম পদে পৌঁছেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কমান্ডের প্রধান নৌ-সেনাপতি ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে যুক্তরাজ্যের সরকারি অর্থভান্ডার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়কার সদ্য নির্বাচিত লেবার সরকার মনে করে, ক্রমে অস্থির হয়ে উঠা ভারতের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের জনসাধারণের সমর্থন পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়াও দুষ্কর হবে। এমতাবস্থায় ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ঘোষণা করেন ১৯৪৮-এর জুনে ব্রিটিশ সরকার ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে। কথিত আছে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন দাঙ্গা থামাতে অসমর্থ ব্রিটিশ বাহিনীর অক্ষমতার কথা মাথায় রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখটি সাত মাস এগিয়ে আনেন। সেই অনুযায়ী ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৫২ সালে মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ ভূমধ্যসাগরীয় নৌবহরের কমান্ডার-ইন-চিফ এবং ন্যাটো কমান্ডার অ্যালাইড ফোর্সেস মেডিটেরিয়ান নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফার্স্ট সি লর্ড, যে পদে তার পিতা ব্যাটেনবার্গের প্রিন্স লুই প্রায় ৪০ বছর আগে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা স্টাফের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে মাউন্টব্যাটেন এক বছর ন্যাটো সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
রাজকীয় নৌ বাহিনীর নিয়মিত চাকরি শেষে মাউন্টব্যাটেন ১৯৬৫ সালের ২৯ জানুয়ারিতে লাইফ গার্ডের কর্নেল এবং গোল্ড স্টিক ইন ওয়েটিংয়ের মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব লাভ করেন। একই বছর তিনি রয়্যাল মেরিনসের লাইফ কর্নেল কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন। ২০ জুলাই ১৯৬৫ থেকে ‘আইল অব উইট’ নামক একটি দ্বীপের গভর্নর ছিলেন এবং ১ এপ্রিল ১৯৭৪ থেকে আইল অব উইটের প্রথম লর্ড লেফটেন্যান্ট নিযুক্ত হন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন আয়ারল্যান্ডে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের কাউন্টি স্লিগোর ক্লিফোনি গ্রামের কাছে মুলাঘমোর উপদ্বীপে ৪ হাজার হেক্টর বা ১০ হাজার একর জমির ওপর একটি বিশাল খামার ও ক্ল্যাসিবাউন ক্যাসেল নামের এক রাজকীয় প্রাসাদ। অবকাশ যাপনের জন্য প্রায়ই তিনি এখানে আসতেন এবং নৌযানে করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্যরা এ সময় নানা কারণে ইংল্যান্ড, রাজপরিবার এবং আয়ারল্যান্ডে আসা ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
২৭ আগস্ট ১৯৭৯ সালে মাউন্টব্যাটেন তার ৩০ ফুট লম্বা কাঠের নৌকা নিয়ে মুল্লাঘোরের বন্দর সংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় চিংড়ি এবং টুনা মাছ ধরতে যান। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সদস্য টমাস ম্যাকমোহন আগের রাতে সবার অগোচরে ৫০ পাউন্ড ওজনের একটি রেডিও-নিয়ন্ত্রিত বোমা নিয়ে অরক্ষিত নৌকায় উঠে পড়ে ছিলেন এবং যথাযথভাবে তা সংযুক্ত করে গোপন করে ছিলেন। মাউন্টব্যাটেন এবং তার দল নৌকাটি তীরে থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে যাওয়া মাত্র বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের শক্তিতে নৌকাটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৭৯ বছর বয়সী মাউন্টব্যাটেনের পা প্রায় উড়ে যায়। কাছাকাছি থাকা জেলেরা তাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে তীরে নিতে থাকে; কিন্তু তীরে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যান। মাউন্টব্যাটেন ছাড়াও নৌকায় ছিলেন তার বড় মেয়ে প্যাট্রিসিয়া, লেডি ব্রেবোর্ন; তার স্বামী লর্ড ব্রেবোর্ন; তাদের যমজ পুত্র নিকোলাস এবং টিমোথি ন্যাচবুল; লর্ড ব্রেবোর্নের মা ডোরিন, ডোগার লেডি ব্রেবোর্ন; পল ম্যাক্সওয়েল এবং স্থানীয় তরুণ নিকোলাস (১৪) এবং পল (১৫)। বিস্ফোরণে এদের সবাই নিহত হন এবং অন্যরা গুরুতর আহত হন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সম্মানে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে একটি আনুষ্ঠানিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয় এবং হ্যাম্পশায়ারের রমসি অ্যাবেতে তাকে সমাহিত করা হয়।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন