যুদ্ধকবলিত গাজায় সর্বকালের নির্মম মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্ব বিবেক নিশ্চুপ, নির্বিকার। মানবতার এই বিপর্যয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাবাসীর পাশে দাঁড়ায়নি কেউ। যুদ্ধে লিপ্ত খোদ ইসরায়েলের নেতা নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ হলেও কর্ণপাত করছে না তারা। সমাবেশ হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে; যা একই সঙ্গে রাজনৈতিক, সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত। এর মধ্যে প্রথমত হামাসের রকেট হামলা ও হামলা প্রতিহত করা। হামাস গাজা শাসন করে, এ কারণে প্রায়ই ইসরায়েলের দিকে রকেট নিক্ষেপ করে। ইসরায়েল এ ধরনের হামলাকে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের মতো বড় হামলার পর নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইহুদি রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক স্বার্থ ও চাপ সৃষ্টি করা। তৃতীয়ত নেতানিয়াহুর সরকার ছিল একটি ডানপন্থি জোট, যার মধ্যে অনেকেই যুদ্ধ ও নিরাপত্তা বিষয়ে কঠোর অবস্থান চায়। এ ছাড়া, নেতানিয়াহু দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন এবং কিছু বিশ্লেষকের মতে, যুদ্ধ পরিস্থিতি তার জন্য রাজনৈতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করেছে। চতুর্থত গাজা ও হামাসকে দুর্বল করা। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে চায় গাজার চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো বিশেষত হামাস ও ইসলামিক জিহাদ দুর্বল হোক, যেন তারা আর ভবিষ্যতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড়সড় হামলা চালাতে না পারে। পঞ্চমত জনগণের দৃষ্টি ঘোরানো ও ঐক্য গড়ে তোলা। যুদ্ধের সময় জাতীয় ঐক্য ও সরকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পায়। নেতানিয়াহু অনেক সময় এ কৌশল ব্যবহার করেন জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতে। ষষ্ঠত আন্তর্জাতিক নীতি ও কূটনীতি। বিশেষ করে ইসরায়েল মাঝেমধ্যে যুদ্ধকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মিত্রদের কাছ থেকে সমর্থন পেতে বা নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে চায়। আর এসব কারণেই নেতানিয়াহুর সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ বন্ধে বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ অব্যাহত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার সাধারণ মানুষের দাবি আমলে নিচ্ছে না। বরং সাধারণ নাগরিকদের গাজা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার জন্য বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর বাংলাদেশ তো বরাবরই যে কোনো দেশে যুদ্ধ, সংঘাত, সহিংসতার বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের এই পররাষ্ট্রনীতির আলোকে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সরকারিভাবে এবং দেশের আপামর মানুষ গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। উল্লেখ্য, প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে পঞ্চাশ হাজারের বেশি। বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রহর গুনছে আরও অনেকেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, বিভিন্ন হাসপাতালেও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এ কারণে যুদ্ধে আক্রান্তরা বাঁচার আশায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আরব দেশগুলোর মধ্যস্থতায় মাঝেমধ্যে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে উভয়পক্ষ সম্মত হলেও, তা তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এতে সহজে অনুমেয়, এ যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পরিবর্তে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধকে উসকে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইসরায়েল-গাজার মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের যেমন কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই, তেমনি বিশ্বের অপরাপর শক্তিধর রাষ্ট্র এমনকি আরববিশ্বও কিছু করতে পারছে না। এমন অবস্থায় যুদ্ধকবলিত গাজার অবশিষ্ট মানুষকে বাঁচতে হবে ক্ষুধা নিয়ে, আলো-পানি, চিকিৎসা ছড়াই। তা ছাড়া আত্মরক্ষার পথ বের করতে হবে, নিজ নিজ কৌশলে বাঁচতে হবে। নতুবা সহায়সম্বল, ভিটেমাটি এবং প্রিয়জনকে হারিয়ে হয়তো অন্য কোনো দেশে পালিয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া অন্যথা নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া বিকল্প নেই তাদের সামনে।
গাজায় যুদ্ধে নারী, শিশু, আবালবৃদ্ধবনিতা কেউ বাদ যাচ্ছে না মৃত্যুর হাত থেকে। হাসপাতাল, শপিং মল, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পকারখানা কিছুই বাদ যাচ্ছে না যুদ্ধের ধামামা থেকে। গাজার অধিকাংশ এলাকায় এখন ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। গাজাবাসীর ওপর শুরু হওয়া যুদ্ধাস্ত্র যেন কোনোভাবেই থামছে না। গাজাবাসীর সবাই যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার হারিয়েছে, হারিয়েছে রাতের ঘুম-শান্তি সবই। দীর্ঘ ইতিহাসে ফিলিস্তিন বহু আগেই হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানবতার শ্মশানভূমি। যুদ্ধের অভিঘাত কতটা মারাত্মক হতে পারে; গাজায় প্রাণঘাতী ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
প্রসঙ্গত, ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তি সংগ্রাম মূলত শুরু হয় ১৯৬৯ সালে, যখন তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। যদিও ফিলিস্তিনি জাতিগত ও ভূরাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস এর আগেও বিদ্যমান ছিল, ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে এ সংগ্রাম একটি সংগঠিত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত রূপ লাভ করে। ১৯৬৫ সালে ইয়াসির আরাফাতের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ফাতাহ প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা চালায়। ১৯৬৬ সালে আরব-ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। পিএলওর ছাতার নিচে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী একত্র হয় এবং এ সময় থেকে আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনি আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে পরিচিতি পায়।
এরই মধ্যে সম্প্রতি ফিলিস্তিনি চিকিৎসক রিফাত রাদওয়ান তার মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি চিঠি বিশ্ববাসীর হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। তিনি লেখেন, ‘মা আমাকে ক্ষমা করো। এ পথটাই আমি বেছে নিয়েছি। আমি মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো, মা। আমি শপথ করে বলছি, আমি কেবল মানুষকে সাহায্য করার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছিলাম।’ এটা ছিল গাজার তরুণ ফিলিস্তিনি চিকিৎসক রিফাত রাদওয়ানের শেষ কথা। রাফার ঠান্ডা রাতের আকাশের নিচে ইসরায়েলি সৈন্যঘেরা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত একটি অ্যাম্বুলেন্সের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি এ কথাগুলো বলেছিলেন। আহতদের বাঁচাতে তিনি তার চিকিৎসক দলের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। কেউ ফিরে আসেননি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালিয়ে রাদওয়ানসহ ১৪ জন জরুরি ভিত্তিতে কর্মরত চিকিৎসককে হত্যা করে। পরে তাদের মৃতদেহ একটি অগভীর কবর থেকে উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে কারও কারও হাত বা পা বাঁধা ছিল। স্পষ্টত, খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করা হয়েছিল। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যদিও তারা চিকিৎসকের পোশাক পরা ছিলেন। সঙ্গে ছিল রেডিও, গ্লাভস ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম। তবুও ইসরায়েল মিথ্যাচার করছে। তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বকে বলেছিলেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো চিহ্নিত করা যায়নি এবং ‘সন্দেহজনক’ ছিল। এ কারণে ইসরায়েলি আক্রমণ ন্যায্য ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের ফুটেজে দেখা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সগুলো স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছিল। আলো জ্বলছিল এবং মেডিকেল জ্যাকেটগুলো দেখা যাচ্ছিল। এতে কোনো হুমকির চিহ্ন ছিল না; ছিল না কোনো ক্রসফায়ার। এমনকি কোনো অস্পষ্টতাও ছিল না। মনে হচ্ছে, এগুলো শুধুই ইচ্ছাকৃত নির্বিচার হত্যা।
এদিকে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর থেকে ভয়াবহতা আরও তীব্র হয়েছে। খাবার নেই, জ্বালানি নেই এবং জলজ উদ্ভিদগুলো নির্জীব হয়ে পড়েছে। গাজার বেকারিগুলো ভেঙে পড়েছে। পরিবারগুলো নালার পানি পান এবং পশুখাদ্য খেতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। অথচ তাদের চিকিৎসা করার জন্য কেউ অবশিষ্ট নেই। এটি ‘সভ্যতা’র নামে ইসরায়েলের যুদ্ধ। দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ‘সীমাহীন যুদ্ধ’ বলে মন্তব্য করা হয়। ইসরায়েল আইন, নীতি ও শালীনতার প্রতিটি সীমা পদদলিত করেছে। এখন গাজার কোনো অঞ্চল নিরাপদ নয়; কোনো হাসপাতাল রেহাই পায় না; কোনো শিশুও বাদ যায় না। এটি কোনো সংঘাত নয়, বরং অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ। এরই মধ্যে জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা পুষ্ট হয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, ‘এটি আমাদের সবার জন্য, সব সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা বর্বরতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে লড়ছি... আমি বিশ্বাস করি, আমরা আমাদের সবার সভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার জন্য একই যুদ্ধে লড়ছি।’
এই মুহূর্তে গাজার পরিস্থিতি শ্বাসরুদ্ধকর। ওষুধ নেই, খাবার নেই, চিকিৎসা নেই, আশ্রয় বা তাঁবুও নেই। অনবরত সংঘাত-সংঘর্ষ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া এ ভূখণ্ড বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘প্রতি বর্গমাইল ভূমি রক্ষার জন্য’ ঠিক কতসংখ্যক জীবন বলিদান করার প্রয়োজন পড়ে! ইসরায়েল গাজায় ‘নিরাপত্তা বাফার জোন’ তৈরি করছে, তার পেছনে আসলে লুকিয়ে আছে অমানবিক এক নির্মম কৌশল। কাজেই সভ্যতা ও মানববিধ্বংসী যুদ্ধ থেকে গাজাকে রক্ষায় বিশ্ব নেতৃত্বকে এখনই এগিয়ে আসা উচিত। এটাই এ মুহূর্তে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
( প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব )
মন্তব্য করুন