একসময় ছিল যখন মানুষ দিনের শুরু করত প্রকৃতির কলতান শুনে, পাখির ডাক, মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙত। দিনের কাজ হতো মুখোমুখি কথোপকথনে, হাসি-কান্না ভাগাভাগিতে। সেই সব দিন পেছনে পড়ে গেছে। এখনকার সময়ে মানুষের ঘুম ভাঙে মোবাইল ফোনের অ্যালার্মে, চোখ খোলার আগেই হাতে উঠে আসে ফোন। যেন জীবনের নিয়ন্ত্রণ এখন এক প্রযুক্তির যন্ত্রে।
মোবাইল ফোন একসময় ছিল শুধু যোগাযোগের মাধ্যম। কথা বলার জন্য, দূরের প্রিয়জনকে কাছের অনুভব দেওয়ার জন্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এটিতে এখন শুধু কথা নয়, বিনোদন, পড়াশোনা, অফিসের কাজ, সামাজিক যোগাযোগ— সবকিছুই নির্ভর করছে। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির এক বিশাল বিপ্লব। কিন্তু এর ব্যবহারে ভারসাম্য না থাকলে তা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। আজকের সমাজে আমরা এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে চলছি—যেখানে আমরা আক্ষরিক অর্থে একে অন্যের সংস্পর্শে খুব কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবিকভাবে দূরে দূরে। এক টেবিলে একসঙ্গে খাচ্ছি, অথচ সবার নজর মোবাইল স্ক্রিনে। বাবা-মা সন্তানকে সময় দিচ্ছেন না, সন্তানও ডুবে আছে গেমে বা ইউটিউবে। এই দূরত্ব শুধু মানসিক নয়, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—এসব প্ল্যাটফর্ম আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে বাস্তবের অনুভব। প্রতিদিন নিজের জীবনের কৃত্রিম ঝলক দেখিয়ে ‘পারফেক্ট লাইফ’ সাজাতে গিয়ে নিজের আসল চেহারাটাই হারিয়ে ফেলছি।
বর্তমানে দুই বছরের শিশু পর্যন্ত মোবাইল ফোনে ইউটিউব দেখতে অভ্যস্ত। তারা মাটিতে খেলা শেখেনি, বরং কার্টুন দেখে খাওয়া শিখছে। স্কুলে পড়া না বুঝে গুগলে সার্চ করছে, অভিভাবকের সঙ্গে গল্প নয়, বরং ট্যাব চায়। এভাবে শিশুদের কল্পনাশক্তি, সামাজিক দক্ষতা এবং আবেগীয় বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মোবাইল আসক্তি শিশুদের চোখের দৃষ্টিশক্তি, মস্তিষ্কের বিকাশ এবং ঘুমের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, মেজাজ খারাপ, মনোযোগে ঘাটতি—এসব সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। অনেকেই বলে থাকেন, মোবাইল ফোন অফিসকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়। তবে এ সুবিধার একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। এখন আর অফিসের সময় শেষ হওয়ার পর বিশ্রামের সুযোগ থাকে না। বসের একটি মেসেজ মাঝরাতেও কাজের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কর্মজীবনের পরিধি এখন ২৪ ঘণ্টায় বিস্তৃত। কাজ আর ব্যক্তিগত জীবনের সীমারেখা ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে মানব সম্পর্কের ওপর। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, বন্ধুদের মধ্যে দূরত্ব, প্রেম-ভালোবাসায় সন্দেহ—সবকিছুর পেছনে মোবাইল একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পর্কের জায়গায় যখন বিশ্বাসের চেয়ে ফোন চেক করাটা বড় হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার চোখের সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ‘ডুম স্ক্রলিং’—অর্থাৎ একটার পর একটা কনটেন্ট দেখেই যাওয়া, যা মস্তিষ্কে অতিরিক্ত তথ্য ঢুকিয়ে ক্লান্তি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। বিষণ্নতা, একাকিত্ব, আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত বাড়ছে।
তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে পরিত্রাণের উপায় কী? বুঝতে হবে মোবাইল ফোন আমাদের সেবা করার জন্য, আমাদের শাসন করার জন্য নয়। এর ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতেই হবে। শিশুদের জন্য বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করা, যেমন—বই পড়া, মাঠে খেলা। মোবাইল ফোনকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, আর তা উচিতও নয়। কিন্তু আমাদের জীবন যেন মোবাইলের প্রযুক্তি আমাদের হাতিয়ার, কিন্তু যদি আমরা সাবধান না হই, তাহলে এ হাতিয়ারই একদিন আমাদের জীবনের শাসক হয়ে উঠবে। আমরা চাই না আমাদের সন্তানদের শৈশব কেটে যাক স্ক্রিনে বা আমাদের সম্পর্কগুলোর মাঝে আসুক এক কাচের দেয়াল। সবাই মিলে প্রযুক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে, মানবিক ও সংবেদনশীল জীবনের দিকে ফিরে আসতে হবে।
জাফরিন সুলতানা, শিক্ষার্থী
আইন ও ভূমি প্রশাসন
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন