বেলিন ফার্নান্দেজ
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মৃত্যুক্ষণে শান্তি প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস

মৃত্যুক্ষণে শান্তি প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস

দীর্ঘকাল অসুস্থ থাকার পর গত ২১ এপ্রিল ৮৮ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন ক্যাথলিক চার্চের প্রধান এবং ভ্যাটিকান সিটির সার্বভৌম প্রশাসক পোপ ফ্রান্সিস। তার ঠিক আগের দিন, ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে ইস্টার সানডের শুভেচ্ছা বার্তায়, রোমান ক্যাথলিক চার্চের এ নেতা ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের খ্রিষ্টান নাগরিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা ব্যক্ত করেন এবং এই সমগ্র অঞ্চলের নির্যাতিত জনগণদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমি গাজার মানুষ এবং বিশেষত সেখানে থাকা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কথা ভাবি। সেখানে চলমান ভয়াবহ সংঘাত এখনো মৃত্যু ডেকে আনছে, চলমান ধ্বংসযজ্ঞ একটা নৈরাশ্যময় ও শোচনীয় মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।’ ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে ইসরায়েল কর্তৃক চালানো গণহত্যায় এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ৫১ হাজার ২০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে এ গণহত্যার কথাই বলেছেন। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন যুদ্ধরত পক্ষগুলো অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, আটককৃত নাগরিকদের মুক্তি দেয় এবং যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তির অপেক্ষায় থাকা ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছে দেয়।

এখানে পোপ ফ্রান্সিসকে কৌশলী ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে। তার বক্তব্যে তিনি গাজার চলমান বিভীষিকাকে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করতে পারেননি। গণহত্যা আর যুদ্ধ দুটো এক জিনিস নয়। ইসরায়েলি পক্ষ, যারা গণহত্যা পরিচালনা করছে আর ফিলিস্তিনের সাধারণ নাগরিক, যারা এই নির্মম অপরাধের শিকার হচ্ছে, তারা কোনো অর্থেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুটো সমান পক্ষ নয়। যাদের জন্য নিরুপায়, নিরীহ ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর আজ এই দুর্দশা, সেই দোষীদের নাম তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে পারেননি। তবুও গোটা পৃথিবী যখন নীরবে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চলতে দিচ্ছে, তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় তার শেষ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এ সাহসটা প্রশংসার দাবি রাখে।

গত মার্চের শুরুতে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সরকার সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য যে বাধ্যতামূলক অনাহার সৃষ্টি করা আর সেটা যে একটা যুদ্ধাপরাধ, সেই ব্যাপারে পোপ ফ্রান্সিস নিশ্চয়ই অবগত ছিলেন। জানুয়ারি মাসে ইসরায়েল আর হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছিল, তা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বারবার লঙ্ঘন করে আসছে। মার্চ মাসে তারা পুরোপুরিভাবে এ চুক্তি ভঙ্গ করায়, পোপ ফ্রান্সিস গত সপ্তাহে আবারও নতুন করে যুদ্ধবিরতির পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

সম্প্রতি জাতিসংঘের এক তদন্তে দেখা গেছে যে, মার্চ মাসের ১৮ তারিখ থেকে এপ্রিল মাসের ৯ তারিখের ভেতর ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভঙ্গ করে যেই কয়টি আক্রমণ চালিয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ৩৬টি হামলার ঘটনায় কেবল নারী ও শিশুদের মৃত্যু ঘটেছে। গাজার অধিবাসীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিশ্চিহ্ন করছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী আর তাদের সমর্থন দিচ্ছে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকা। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যেও ক্ষমতা খাটানোর সামর্থ্য এ পরাশক্তিরই সবচেয়ে অধিক। তাই দুর্দশাগ্রস্ত এ মানুষগুলোর পক্ষে একটা শান্তির ভবিষ্যৎ আশা করাটা যেন নিছক কল্পনা মাত্র।

পোপ ফ্রান্সিস যেদিন তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফ্রান্সিস উন্মুক্তভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের বারবার সমালোচনা করেছেন এবং তার নির্বাসন-নীতিগুলোকে কটাক্ষ করেছেন বিধায় ভ্যান্স তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভ্যাটিকান সিটি সফর করেন। দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষ এবং অভিবাসীরা যে বর্তমানে অবজ্ঞা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘৃণার শিকার হচ্ছে, পোপ তার ইস্টার সানডের বার্তায় এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা যে অসম্ভব নয়, এই বার্তার ওপর তিনি জোর দেন এবং এই আশা নবায়নের অনুরোধ জানান।

তবে অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, অবজ্ঞা আর মানবতাহীনতা—এ দুই স্তম্ভের ওপর এখন দাঁড়িয়ে আছে নিরাশাব্যঞ্জক আমাদের বিশ্বব্যবস্থা, যেই ব্যবস্থার প্রতিপালক যুক্তরাষ্ট্র। মানবিক শিষ্টাচারকে গৌণ করে এ ব্যবস্থায় স্বৈরতান্ত্রিক অভিজাতশাসন আর ব্যবসায়িক মুনাফাকেই মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত করা হচ্ছে। একদিকে গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য যেই অস্ত্র প্রয়োজন, সেই অস্ত্র নির্মাণ করে এবং জোগান দিয়ে তার থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, অনিবন্ধিত শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এসবই মূলত করা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক লাভের উদ্দেশ্যে।

এই ইস্টার সানডেতে যে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব’—বার্তাটা বিশ্ববাসীর উদ্দেশে দেওয়া হলো, এটা বস্তুত গাজায় অবস্থানরত ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানদের জন্য বা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চলে জীবন অতিবাহিত করা খ্রিষ্টান নাগরিকদের জন্য সত্য নয়। এমনকি জেরুজালেম, বাইবেলের তথ্য অনুযায়ী যেখানে যিশুখ্রিষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই অঞ্চলে বসবাসরত খ্রিষ্টানদের জন্যও এ কথা সত্য বলে ঠাওর হচ্ছে না। অশান্তি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়ে গেছে। গত রোববার গাজা শহরের পরফিরিয়াস গির্জায় ইস্টার সানডে উদযাপনে একত্রিত হয়েছিলেন সেখানকার খ্রিষ্টান নাগরিকরা। ২০২৩-এর অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই গির্জার ওপর বোমাবর্ষণ করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গির্জায় আশ্রয় নেওয়া অন্তত ১৮ জন ফিলিস্তিনি সেই ঘটনায় প্রাণ হারায়, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খ্রিষ্টান।

পশ্চিম তীরে এবং জেরুজালেমে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অনেক খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের তাদের তীর্থস্থানে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখছে। ইহুদি বসতি স্থাপনকারী এবং সরকারি মদদপুষ্ট কিছু ব্যক্তি এসব জায়গায় বারবার হামলা চালিয়েছে এবং এখানে বসবাসরত খ্রিষ্টানরা তাদের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এ বছর অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের সেপুলখার গির্জায় ইস্টার সানডের প্রার্থনায় মাত্র ছয় হাজার ফিলিস্তিনির অংশ নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইসরায়েলি সরকার, তাও কড়া সামরিক তত্ত্বাবধানে। আলজাজিরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে যে, ভ্যাটিকান সিটি থেকে যে ক্যাথলিক প্রতিনিধিদল এসেছিল, তাদেরও গির্জায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ ঘটনার এক দিন পরেই রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান প্রতিনিধি পোপ ফ্রান্সিস পাড়ি জমান অনন্তলোকে। মৃত্যুর আগে যে তিনি তার বিদায়বার্তায় গাজায় যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কেউ কি আদপে তার সেই অনুরোধের মূল্য রাখবে?

লেখক: আমেরিকান সাংবাদিক, কলামিস্ট

নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গান লিখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরও করলেন

আবহাওয়া নিয়ে ঢাকাবাসীর জন্য কোনো ভালো খবর নেই

ভারতের বিষয়ে সৌদি আরবকে জানাল পাকিস্তান

এক বাইকে ঘুরতে বের হয় ৩ বন্ধু, পথে প্রাণ গেল একজনের

কুয়েটের ভিসি-প্রোভিসিকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন

পহেলগামে হামলা / ঘটনার ১০ মিনিট পরই কীভাবে মামলা হলো, বাড়ছে সন্দেহ

সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফ সাক্ষাৎ, জিরো লাইন পরিদর্শন 

২৬ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

যুদ্ধের শঙ্কায় ‘অপারেশন রুমে’ ব্যস্ত পাকিস্তান

ভারত-পাকিস্তান সংকটে ট্রাম্প কি হস্তক্ষেপ করবেন?

১০

কাশ্মীর ইস্যুতে ইরানকে পাশে চাইছে পাকিস্তান

১১

২৬ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১২

কুমিল্লায় শক্তি প্রদর্শনে কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্র মহড়া, আটক ৩

১৩

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪

গাজায় নির্বিচারে হামলার সবশেষ অবস্থা

১৫

কুমিল্লায় শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ ইমাম আটক

১৬

প্রশাসনে আ. লীগের লোকদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চালু হয়েছে: আসাদুজ্জামান রিপন

১৭

অস্ত্র ও জাল টাকাসহ ৩ ডাকাত আটক

১৮

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ী নিহত 

১৯

যারা নির্বাচন চায় না তারা গণতন্ত্রের শত্রু: মাহবুব উদ্দিন খোকন

২০
X