পূর্বে প্রকাশের পর
পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমের সফলতা বিঘ্নিত কেন তা আলোচনা করতে গেলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ খাতের সমগ্র চিত্রটি আমাদের সংক্ষিপ্তভাবে একটু পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পল্লী বিদ্যুৎকে বাদ দিলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় বিতরণ, পরিচালন, উৎপাদন, সঞ্চালন ব্যবস্থা প্রচণ্ডরকম হতাশাজনক। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভূখণ্ডে অর্থাৎ গ্রামীণ এলাকায় যদি একটি ব্যর্থ ও অকার্যকর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হতো, তা হতো দেশের দুর্বল অর্থনীতিকে চিরতরে পঙ্গুত্ব বহন করার শামিল। দেশ ও অর্থনীতির গুরুত্ব বিবেচনায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের [বিউবোর্ড] মতো অকার্যকর প্রতিষ্ঠান নয়, যথাযথ মানসম্পন্ন বিতরণ, পরিচালন, উৎপাদন, সঞ্চালন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে পারে সে-ধরনের একটি বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ এলাকায় স্থাপন করা ভীষণ প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। সে বিবেচনায় পল্লী বিদ্যুতের সৃষ্টি। যদিও অদ্যাবধি তার আংশিক ব্যবস্থামাত্র কার্যকর করা হয়েছে। শহুরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিয়ে আমরা রীতিমতো নাস্তানাবুদ। গ্রামীণ অর্থনীতির বর্ণাঢ্য বিকাশে প্রয়োজন হলো নিরবচ্ছিন্ন, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন, গুণগত বিতরণ, সঞ্চালন ও পরিচালন ব্যবস্থা। পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে গুণগত বিতরণ, সঞ্চালন ও পরিচালন ব্যবস্থা দৃশ্যমান হলেও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার যে প্রধান উপাত্ত, বিদ্যুৎ উৎপাদন তার অনুপস্থিতি গ্রামীণ বিদ্যুতের অর্জিত সব সফলতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। অথচ ১৯৭৭ সালের প্রেসিডেন্ট অর্ডিন্যান্সের যে ঘোষণাবলে পল্লী বিদ্যুৎ কার্যক্রম শুরু হয়, সে অর্ডিন্যান্সে স্পষ্টই নির্দেশ ছিল, ‘এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ, উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও রূপান্তর পদ্ধতি গ্রহণ করিবে।’ তাহলে পবিবোর্ডকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না দিয়ে বিউবোর্ড থেকে মানহীন, অনির্ভরযোগ্য, অনিরাপদ ও উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা মানে গ্রামের বর্ণাঢ্য অর্থনীতিকে শুধু ধ্বংস করা নয়, দেশের অর্থনীতির প্রধান শক্তি গ্রামীণ জনগণকে চরম প্রতারণা করা। এ বিষয়ে স্পষ্টায়নের জন্য আমরা বিউবোর্ডের ট্যারিফ পর্যালোচনা করে দেখতে পারি। পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম শুরুর মুহূর্তে যে সংকটগুলোকে বিবেচনায় এনে এ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল মানহীন ও বিভ্রাটযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে নিজস্ব মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তন। অতীত থেকে ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন’ ব্যবস্থা আজ আরও অনির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে গেছে বলা যেতে পারে। অনিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ফ্রিকোয়েন্সির ওঠানামা, ত্রুটিপূর্ণ ভোল্টেজ নিয়ে যে উৎপাদন ব্যবস্থা তা থেকে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে পল্লী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভালো বিদ্যুৎ দিতে পারবে তা আশাই করা যায় না। একটি সুষ্ঠু বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রাথমিক ধারণাই হলো তার উৎপাদন ব্যবস্থা যথাযথ মানের থাকতে হবে। পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে আজ অবধি গুণগত বিতরণ, সঞ্চালন ও পরিচালন ব্যবস্থায় যে সুনামটুকু অর্জন করেছে, আজ কিন্তু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মানহীন ও নিম্নমানের বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে বিদ্যুৎ গ্রহণ করে তো সুন্দর ও পরিশীলিত বিতরণ ও পরিচালন দিয়ে ভোক্তাদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির যে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা নেই, ভোক্তারা সেটা বুঝতেই পারছে না। তাদের দাবি হলো, যে বিদ্যুৎ দেয়, তাকেই সব বুঝিয়ে দিতে হবে। কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের এ চরম ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে আর দেশের প্রায় ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ ভোক্তাকে, যারা প্রকৃতই জিডিপির ৫০ থেকে ৬০ ভাগ অর্থ জোগান দেয়। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির এ অবদানের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি সেমিনারের প্রতিবেদন এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে—‘দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো কৃষি। তবে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সেবা খাতের আওতা। আর জিডিপিতে ছোট হতে থাকে কৃষির অবদান। তারপরও দারিদ্র্য বিমোচনে এখনো প্রধান নিয়ামক কৃষি। কারণ দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষির। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে কৃষি ফসল। এখন সময় এসেছে ফসলের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনের। এর অংশ হিসেবে হর্টিকালচার, অ্যাকুয়াকালচার, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য চাষে আরও জোর দিতে হবে। কিন্তু এ খাতের আওতা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না।’ আর এ না বাড়ার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকই হলো সুষ্ঠু বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অভাব।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলের ৮০ থেকে ৮৭ শতাংশ মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। কৃষির এ বিবর্তন ও উন্নয়নের হাত ধরে কমেছে দারিদ্র্য। গবেষণায় দেখা যায়, কৃষি ও অকৃষি উভয় খাত থেকে অর্থ উপার্জন হয় গ্রামাঞ্চলের ৬৫ শতাংশ পরিবারের। আর গ্রামীণ তথা এক অর্থে মূলত জাতীয় অর্থনীতির বর্ণাঢ্য বিকাশে প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় গুণগত মানের বিদ্যুৎ, উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও রূপান্তর পদ্ধতি গ্রহণ করার। যা হবে মানসম্পন্ন, নির্ভরশীল ও সাশ্রয়ী। পল্লী বিদ্যুতের ১৯৭৭ সনের অর্ডিন্যান্সে যেমন লিখা আছে, ‘অর্থনৈতিক কার্যাদি যথা, কৃষিউন্নয়ন ও পল্লী শিল্প স্থাপন এবং সমাজের অনুন্নত অংশের আয় বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা প্রদানের জন্য বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান পূর্বক পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ;’ পল্লী বিদ্যুতে অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক অনেক গ্রাহক সংযুক্ত হলেও অপ্রতুল বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আশাজনক রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট প্রতিফলিত হচ্ছে না। আমরা বিউবোর্ড ও পবিবোর্ডের গ্রাহক সংখ্যা ও বিদ্যুৎ চাহিদা পরখ করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বিউবোর্ডের মাত্র ৩৫ লাখ গ্রাহক সংখ্যা নিয়ে যেখানে বিদ্যুৎ চাহিদা ৯৯০০ মেগাওয়াট আর সেখানে প্রায় ৪ কোটি গ্রাহক সংখ্যা নিয়ে পবিবোর্ডের বিদ্যুৎ চাহিদা ৪৫০০ মেগাওয়াট। এবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফুয়েলের ব্যবহার ও ব্যয় জানলে আমরা সম্ভবত একটি ধারণা নিতে পারি যে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতটাকে কেন ‘সোনার খনি’ বিবেচনা করা হয় এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত কেন বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর আওতায় রাখা হয়। এটাও জানবেন, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোনো সভায় হাজির হন না, আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষরে তারা অত্যন্ত সক্রিয় একজন সদস্য হিসেবে ধরা দেবেন। আমাদের সৌভাগ্য বলা যায় প্রাকৃতিকভাবে আমরা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস পেয়েছিলাম। আর তা না হলে দেশের লুটেরারা আমাদের যে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যেত তা বর্তমানে এলএনজি টার্মিনাল বানানো, এলএনজি আমদানির ব্যবসার তাড়া দেখে কি বুঝতে পারছি না? এটা কি আমরা ধারণা করতে পারি যে অফশোরের অর্থাৎ সমুদ্রবক্ষের গ্যাস না তোলার আগ্রহটা বেশি দেখিয়ে জ্বালানি সিন্ডিকেটের সদস্যরা কীভাবে বহু কোটি ব্যয়ে এলএনজি টার্মিনাল বানিয়ে এলএনজি আমদানির ব্যবসায় নেমে গেল। বরাবরের মতো বলা যায় আমাদের গলা কেটে এ লুটেরা সিন্ডিকেট সদস্যরা আমাদের নিজেদের গ্যাস উত্তোলনের সময়টা দীর্ঘ করে এবারও হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ফাঁদিয়ে নিল। তারা বা তাদের দখলীকৃত রাষ্ট্রের পা-পোষা মোসাহিবেরা কখনো জনগণকে জ্বালানি বা জ্বালানির দাম ও তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তার মূল্য কত পড়বে, স্পষ্ট করে বলবে না। এরা একটা গড় দাম বলে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখে। আমি ফুয়েলভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম যাচাইয়ের পরামর্শ দিতে চাই। ‘সরকারের’ অত্যন্ত প্রিয় ব্যবসায়ী অলিগার্কদের থেকে আমরা বিদ্যুৎ কিনছি Independent power producers (IPPs) Tariff: Tk 14.62, Rental plants Tariff: Tk 12.53। এ থেকে মুক্তি তো পেতেই হবে। আর তার সর্বোত্তম পন্থা এবং সম্ভবত একমাত্র উপায় হচ্ছে এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেমসহ সম্পূর্ণ সোলার প্লান্ট। এ সম্পর্কে যারা প্রশ্ন রাখবেন, প্রশ্ন করার আগেই আমি সম্ভাব্য উত্তরগুলো বলে দিচ্ছি—
এক. একটি ২০ মেগাওয়াট সম্পূর্ণ স্টেশনের মূল্য পড়বে ইউএস ডলার ২৪ মিলিয়ন;
দুই. লাইফ সাইকেল ২৫ বছর;
তিন. সংরক্ষণ ব্যয় গড়ে প্রতি বছর ১ শতাংশ;
চার. এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের সম্ভাব্য মূল্য ইউএস সেন্টস ৫.৫০;
পাঁচ. এ ট্যারিফ ২৫ বছরে আর বৃদ্ধি পাবে না। এ হিসাবে সর্বাধিক ৪ বছরে ইউএস ডলার ২৪ মিলিয়নের রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট হয়ে যায়। এগুলো Distributed Generation type হবে। পাশাপাশি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি [পবিস] সমূহের আন্তঃসংযুক্তির সুবিধা রাখা যেতে পারে। এতে কী কী সুবিধা হবে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট হবে না, লোডশেডিং হবে না, অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, মানসম্মত বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, ফ্রিকোয়েন্সির ওঠানামা হবে না, ভোল্টেজের ওঠানামা হবে না, ট্যারিফ বৃদ্ধি পাবে না। একবার অতীতে চরম লোডশেডিংয়ের সময় নিজেদের সিস্টেম রক্ষার্থে তিনটি পবিসে [ঢাকা, টাঙ্গাইল ও কুমিল্লা পবিস] টেন্ডার ডেকে Small Independent Power Plant [SIPP] বসিয়ে সাময়িক উদ্ধার পেয়েছিল, আজও পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে গুণগত বিতরণ, সঞ্চালন ও পরিচালন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এবং গ্রামীণ বিদ্যুৎ ভোক্তাদের মুক্তি দিতে অবিলম্বে Distributed Generation type সোলার ও বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবস্থা SIPP হিসেবে স্থাপন করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে শুধু পল্লী বিদ্যুতের গ্রামীণ বিদ্যুৎ ভোক্তারাই বাঁচবে না, দেশও বাঁচবে।
লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়
মন্তব্য করুন