তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে চলমান রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার সমঝোতার মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করলেও, তার কোনো বাস্তব রূপ এখন পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়নি। চেষ্টা যে তিনি করেননি, এমনটা নয়। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্টের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে অনেকবার ফোনালাপের মাধ্যমে কথোপকথন চালিয়েছেন এবং একবার সরাসরি বৈঠকও করেছেন। এ ছাড়া সৌদি আরবের জেদ্দায় ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের ইউক্রেনীয় সমকক্ষদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। ট্রাম্পের প্রধান পররাষ্ট্র দূত স্টিভ উইটকফ গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত দুবার রাশিয়া সফর করেছেন এবং বর্তমানে ক্রেমলিনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নিকট ভবিষ্যতে স্থায়ী ও কার্যকর শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আপাত দৃষ্টিতে ক্ষীণ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে। এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলোর পাশাপাশি হোয়াইট হাউস কিয়েভ ও মস্কো, উভয়পক্ষের সঙ্গেই নীরব আলোচনায় নিযুক্ত রয়েছে। বস্তুত দুটো দেশই এখন যুদ্ধের ইতি টানতে চায়। রাশিয়ার অর্থনীতিও বর্তমানে গভীর সংকটে আছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের আক্রমণের পর থেকে এ পর্যন্ত আট লাখেরও অধিক রুশ সেনা প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়েছে। তারপরও ইউক্রেনে প্রতিনিয়তই রাতের অন্ধকারে সাধারণ নাগরিকদের আবাসস্থল ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এ আক্রমণের ফলে ইউক্রেনের প্রধান দুটি নৌবন্দর এখনো বন্ধ আছে। পূর্বাঞ্চলের শহরগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আর লাখ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক দেশত্যাগ করে অন্য কোথাও নিরাপত্তার সন্ধান করতে বাধ্য হয়েছে।
কেবল ট্রাম্প নিজে ছাড়া আর কেউই প্রকৃতপক্ষে জানে না যে তার পরিকল্পনা আসলে কী। তবে এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে তুলতে হলে দুটো মৌলিক উপাদানের উপস্থিতি অপরিহার্য। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, ইউক্রেনের জন্য একটি ন্যায়সংগত ও সুবিচারভিত্তিক সমঝোতার ব্যবস্থা করা এবং দ্বিতীয়টি হলো, এমন দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, যা ভবিষ্যতে নতুন করে সংঘাত শুরুর সম্ভাবনাকে কার্যকরভাবে রোধ করতে সক্ষম হবে।
এখন ন্যায়সংগত একটি সমঝোতায় উপনীত হতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। এর মধ্যে ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো, ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময় থেকে রাশিয়া যেসব ভূখণ্ড জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে, সেগুলোর ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি না পায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা। যদিও ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ এবং অনেক নাগরিকই গোপনে মেনে নিয়েছে যে, নিকট ভবিষ্যতে সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তারা ক্রিমিয়া কিংবা পূর্ব ইউক্রেনের দখল হয়ে যাওয়া অংশ পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। কিন্তু তবুও তারা একত্রভাবে এই দাবিতে অটল যে, রাশিয়ার এ দখলদারিত্বের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া চলবে না। এমন জটিল ব্যবস্থার কিছু নজির নিকট অতীতেই বিদ্যমান। যেমন উপসাগরীয় অঞ্চলের গ্রেটার তুন্ব, লেসার তুন্ব ও আবু মুসা দ্বীপগুলোর কার্যত নিয়ন্ত্রণ বহু বছর ধরে ইরানের কাছে থাকলেও, আন্তর্জাতিক মহলে সেগুলোকে এখনো সংযুক্ত আরব আমিরাতের অংশ হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আরও কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যুদ্ধবন্দিদের বিনিময়, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি এবং অপহৃত ইউক্রেনীয় শিশুদের দেশে ফিরিয়ে আনা। উভয়পক্ষের কাছে এখনো হাজার হাজার বন্দি আটক রয়েছে। তাদের বিনিময় একটি বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে, যা উভয়পক্ষের জন্যই ইতিবাচক ও কাম্য। তবে শান্তি প্রক্রিয়া প্রকৃত অর্থে কার্যকর করতে হলে, রাশিয়া কর্তৃক অপহরণকৃত ১৯ হাজার ইউক্রেনীয় শিশুকে নিজ দেশে ফিরতে দেওয়াটা একটা আবশ্যিক পদক্ষেপ হতে হবে।
এ ছাড়া ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক মহল থেকে ব্যাপক সহায়তার প্রয়োজন পড়বে। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা পূর্ণমাত্রিক যুদ্ধের ফলে দেশের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। পরিবহন ব্যবস্থা, জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যম এবং আবাসন—সবকিছুই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর পুনর্গঠন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল ব্যাপার। এ পুনর্নির্মাণ প্রকল্প অর্থায়নের প্রধান দায়ভার ট্রাম্প ইউরোপের দেশগুলোর ওপরই চাপিয়ে দেবেন বলে ধারণা করা যায়। তবে দেশটিকে সঠিকভাবে পুনর্গঠন না করলে যে ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার ঝুঁকি থেকে যাবে, তা নিশ্চিত।
যে কোনো শান্তিচুক্তিকে স্থায়ী করতে হলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চুক্তিতে আবদ্ধ সদস্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিল তার ন্যাটোর সদস্যপদ অর্জন করা। তবে সেই পথ আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। ট্রাম্প নিজে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছেন। বর্তমানে ইউরোপের বেশ কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্রও গোপনে একই মত পোষণ করছে বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। তবে ভবিষ্যতে আবারও যুদ্ধ প্রতিহত করার যেন প্রয়োজন না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে ন্যাটো ছাড়া অন্য ধরনের নিরাপত্তার পথ অবলম্বন করতে হবে ইউক্রেনকে।
সে ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে যুদ্ধের বর্তমান সীমারেখা বরাবর একটি বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশন মোতায়েন করা। এই মিশন বেসামরিক কিংবা সামরিক, যে কোনো ধরনেরই হতে পারে। তবে এ পরিকল্পনায় এমন পক্ষদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যারা যুদ্ধরত উভয়পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। একটা ভিন্ন রকমের সমাধানের পথ হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) ‘পেনিনসুলা শিল্ড ফোর্স’কে এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। যদিও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব নিরসনের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ প্রচলিত নিয়মের বাইরে, তবুও এটি উপসাগরীয় দেশগুলোকে নিরপেক্ষ পক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেবে এবং যুদ্ধরত দুটি দেশই তাদের ওপর আস্থা রাখতে সক্ষম হবে।
পর্যবেক্ষক হিসেবে যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন, তার দায়িত্ব কেবল যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানো নয়, একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা যে, ভবিষ্যতে যেন ইউক্রেন আবারও রাশিয়া কর্তৃক আগ্রাসনের শিকার না হয়। ইউক্রেনের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আগ্রহীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট এই লক্ষ্যে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। এই বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও, তার উপস্থিতিই একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। ন্যাটোর পতাকার অধীনে না হলেও, ব্রিটিশ, ফরাসি, তুর্কি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর জোট যতক্ষণ পর্যন্ত না ইউক্রেনের মাটিতে অবস্থান নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইউক্রেনের সরকার এবং জনপদ নিরাপদ বোধ করবে না।
আর ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অবশ্যই পরোক্ষভাবে হলেও যুক্তরাষ্ট্রকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও ট্রাম্প আমেরিকান সেনা মোতায়েনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে নাকচ করে দিয়েছেন, তবুও ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। আমেরিকার সাহায্যের কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে অস্ত্র সরবরাহের ধারাবাহিকতা, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্প পুনর্গঠনে সহায়তা অথবা ইউরোপীয় বাহিনীগুলোর জন্য অপরিহার্য বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করা। এর মধ্যে রয়েছে গোপন তথ্য আদান-প্রদান, সরবরাহ ও রসদ সহায়তা এবং বিমানের মাধ্যমে আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহের সক্ষমতা।
তবে এসব কূটনৈতিক পরিকল্পনার গতিবিধি যেমনই হোক না কেন, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব অবশ্যই অক্ষুণ্ন থাকতে হবে। দেশটির নিজস্ব নির্বাচন অনুষ্ঠানের অধিকার, নিজস্ব মিত্র নির্ধারণের স্বাধীনতা, কোন কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা জোটে সে যোগ দেবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার পূর্ণ স্বকীয়তা—এসব বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিপথে মস্কোকে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়া যাবে না, দিলে তা একটি শঙ্কাজনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একই কথা প্রযোজ্য রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নেও। একবিংশ শতকে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে শুধু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিবেশী দেশের ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া এবং তা ধরে রাখার বৈধতা পাওয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। বাস্তবিক অর্থে এমন ঘটনা শেষ ঘটেছিল ১৯৯০ সালে, যখন সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করে তার দখল নিয়ে নিয়েছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধাবসানের প্রচেষ্টাগুলোকে সব পক্ষেরই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। যদি তিনি সফল হন, তবে সেটা হবে পররাষ্ট্রনীতির জগতে এক ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু এ শান্তিচুক্তি এমন হতে হবে, যা ইউক্রেনের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখে এবং পূর্ব ইউরোপে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার ভিত্তি গড়ে তোলে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে অবস্থিত কোনো এক বা একাধিক নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাহসী চিন্তাধারাকে বাস্তব রূপ দেওয়া এবং সমস্যার সৃজনশীল সমাধান খুঁজে বের করার এখনই সময়। দ্রুত এ দ্বন্দ্বের ন্যায়সংগত এবং স্থায়ী সুরাহা করা প্রয়োজন, শুধু ইউক্রেনের জনগণের জন্যই নয়, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও বৈশ্বিক শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেও।
লেখক: আমেরিকার হাডসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন