শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এটি একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ এক গভীর অন্তঃসারশূন্য সময় পার করছে। যেখানে গন্তব্য অস্পষ্ট, দিকনির্দেশনা বিবর্ণ, আর লক্ষ্য অনির্দিষ্ট। যেখানে জ্ঞানের গভীরতা নেই, চিন্তার মুক্তি নেই, যুক্তির তীক্ষ্ণতা নেই। এ এক নিষ্প্রভ, অন্তঃসারহীন ব্যবস্থা, যা জাতিকে এগিয়ে নেয় না; বরং অদৃশ্য এক শিকলে আবদ্ধ রাখে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যা হচ্ছে এর উদ্দেশ্যহীনতা। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা চাকরিমুখিতায় পরিণত হয়েছে। যেখানে প্রতিযোগিতার নামে চিন্তার সৃজনশীলতা ধূলিসাৎ হচ্ছে। শিক্ষা যেন আজ মুখস্থ বিদ্যার একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। এখানে দক্ষতা, চিন্তা ও যুক্তি—এই তিনটি স্তম্ভ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এ ব্যবস্থার প্রভাব অর্থনীতিতে সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে শিল্প খাত দুর্বল, প্রযুক্তি খাত স্থবির এবং উদ্যোক্তা মনোভাবের চর্চা নিষ্ক্রিয়। প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা গবেষণার সুযোগ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। যার ফলে মেধা পাচার একটি নীরব দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা আরও গভীর ক্ষত তৈরি করছে। মুক্তচিন্তার চর্চা রুদ্ধ করে রাজনৈতিক প্রভাবশালী শক্তিগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার মঞ্চে পরিণত করেছে। চিন্তা এখানে স্বাধীন নয়, বরং দলীয় আনুগত্যে বন্দি। আর এই সংকীর্ণ রাজনৈতিক ভাবনা সমাজে ছড়িয়ে সহিংসতা, মতাদর্শিক সংঘাত এবং সৃজনশীলতার অভাব তৈরি করছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগান্তকারী করতে হলে প্রথমেই এর কেন্দ্রীভূত ধারণা ভাঙতে হবে। এটি একটি সার্বিক রূপান্তর, যেখানে শিক্ষা হবে জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। শুধু পঠন-পাঠনের কাঠামো নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজকে ঢেলে সাজানোর অস্ত্র হবে। শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে মানসিক বিকাশ, সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাধারা গড়ে তোলা। যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী ভাববে, বিশ্লেষণ করবে এবং প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাবে। এই সাহস ছাড়া জাতি কখনো অগ্রসর হতে পারে না। শিক্ষা হবে সেই শক্তি, যা শিক্ষার্থীকে শেখাবে শুধু উত্তর নয়, প্রশ্ন করতেও। কারণ, প্রশ্নহীন শিক্ষা মৃত চিন্তার জন্ম দেয়। তাই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের পাশাপাশি কিছু যুগান্তকারী ও অভিনব পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, যা শিক্ষার মান ও প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি করবে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করবে।
পাঠ্যক্রমের সংস্কার করে যুগোপযোগী ও ব্যবহারিক জ্ঞাননির্ভর করতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত এবং মানবিক শাখার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এ ছাড়া সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বিকাশের ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় গবেষণা ও উদ্ভাবনের অভাব প্রকট। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার মনোভাব গড়ে তুলতে স্কুল ও কলেজ পর্যায় থেকেই গবেষণামূলক প্রকল্প, বিজ্ঞান মেলা, উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতা এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি চালু করতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষায় শিল্প-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করতে হবে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কারিকুলাম ডিজাইন, ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে শিক্ষার্থীরা শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাবে। শিক্ষায় বহুভাষিকতা ও বৈশ্বিক দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), মেশিন লার্নিং এবং ডাটা সায়েন্সের মতো প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং এ ধরনের প্রযুক্তি শেখা ও ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে। ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন কনটেন্ট এবং ভার্চুয়াল লার্নিং সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট ও ডিজিটাল ডিভাইসের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবন দক্ষতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, কাউন্সেলিং এবং জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহনশীলতা, সহমর্মিতা এবং দলগত কাজের দক্ষতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর মানে শুধু নতুন পাঠ্যবই ছাপানো নয়, এটি একটি জাতির মানসিক গঠনের পুনর্বিন্যাস। শিক্ষাবিপ্লব ছাড়া অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষার ভিত্তি শক্ত না হলে জাতির ভিত্তিও দুর্বল হবে। বাংলাদেশ যদি সত্যিই উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে চায়, তবে শিক্ষার্থীদের এ মুখস্থ বিদ্যার কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে এবং শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে সৃজনশীল, স্বাধীন, প্রযুক্তিনির্ভর এবং দক্ষতাভিত্তিক। এটি হবে একটি অস্ত্র, যা জাতিকে পুনর্জাগরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক, আলোকিত ও উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে সবাইকে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে কাজ করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ আগামী দিনের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের মঞ্চে নেতৃত্ব দেবে।
প্রজ্ঞা দাস, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ইডেন মহিলা কলেজ
মন্তব্য করুন