ফিলিস্তিন: এক শতাব্দীর অস্তিত্বের লড়াই
১৯১৭ সালে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ঘোষিত বেলফোর ঘোষণা ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনের জন্মভূমি দখলের পথ প্রশস্ত করা। সেই ঘোষণার পর থেকেই ফিলিস্তিনিরা এক দীর্ঘ বেদনাময় ইতিহাসের মধ্য দিয়ে চলেছে। ১৯১৭ থেকে ২০২৫—শত বছর পার হলেও সেই সংকটের অবসান ঘটেনি, বরং পরিস্থিতি ক্রমেই আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী ১ হাজার ২০০ জন নিহত ও ২৫১ জন অপহৃত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫১ হাজার ফিলিস্তিনি। এ সহিংসতা এখনো থামেনি।
বহিঃশক্তির ছায়ায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে নিজের জন্মভূমিতেই আজ ফিলিস্তিনিরা বারবার বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। মুসলমানদের তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। কখনো জন্ম হচ্ছে মৃত মায়ের গর্ভ থেকে, প্রতিটি নিঃশ্বাস কাটছে মৃত্যুর আশঙ্কায়। শতবর্ষ পেরিয়েও যেখানে মুক্তির আশা নেই, প্রতিটি দিনই যেন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক করুণ যুদ্ধ।
বেলফোর ঘোষণা: মানব ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী বঞ্চনার প্রতীক
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর একটি চিঠিতে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানান। মাত্র ৬৭ শব্দের এ ঘোষণাপত্রটি ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি এবং ফিলিস্তিন সংকটের সূচনা করে।
চিঠিটি পাঠানো হয় জায়নবাদী সমর্থক ধনাঢ্য ইহুদি নেতা লিওনেল রথসচাইল্ডকে। তাতে বলা হয়, ইহুদি আবাসভূমি গড়তে সহায়তা করা হবে, তবে অ-ইহুদি জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে না। বাস্তবে এ ঘোষণার পর ইহুদি অভিবাসন বাড়তে থাকে এবং আরবদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতক মনে করে, কারণ অটোমানদের বিরুদ্ধে তারা ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যার পেছনে বেলফোর ঘোষণার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। ইহুদিদের কাছে এটি ছিল জাতির স্বপ্নপূরণ, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি বাস্তুচ্যুতি ও অব্যাহত সংঘাতের সূচনা। এ ঘোষণায় ফিলিস্তিনিদের পরিচয় ‘অ-ইহুদি সম্প্রদায়’ হিসেবে উল্লেখ করাও তাদের দীর্ঘস্থায়ী বঞ্চনার প্রতীক হয়ে আছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বনাম মানবাধিকারের টোকেনিজম: মানবাধিকারের নামে গড়ে ওঠা বিশ্বব্যবস্থা আজ গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে যে মানবিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে, তা শুধু পরিসংখ্যান নয়—এ এক নৃশংসতা যেখানে নারী, শিশু, সাংবাদিক, চিকিৎসক—কেউ রেহাই পাচ্ছে না।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ছয় মাসে নিহত প্রায় ৩৪ হাজার ৫০০ মানুষের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার অভাবে অঞ্চলটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। ১৬ জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কার্যকর হওয়ার আগেই আরও ৭৩ জন নিহত হয়। এরপরও ইসরায়েল মানবিক সহায়তা বন্ধ করে, UNRWA-র কার্যক্রম স্থগিত করে এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ রাখে। দ্বিতীয় ধাপ শুরুর আগেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে পুনরায় হামলা শুরু হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বললেও কার্যকর প্রতিরোধ নেই। ৭ এপ্রিল ২০২৫-এ জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফিলিস্তিনি জীবন ধ্বংস হচ্ছে—কেউ বোমায় মারা যাচ্ছে, কেউ ধীরে নিঃশেষিত হচ্ছে ক্ষুধা, নিরাপত্তাহীনতা ও চিকিৎসার অভাবে। পার্থক্য কেবল মৃত্যুর ধরন ও গতি।’ অথচ সেই বিবৃতির পরেও আগ্রাসন থেমে নেই।
ওয়াটসন ইনস্টিটিউট জানায়, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৩ জন সাংবাদিক নিহত হচ্ছেন; মোট প্রাণহানি ২৩২ জন। নিহত ত্রাণকর্মী ৪০৮ জন, যাদের মধ্যে UNRWA-র ২৮৪ ও রেড ক্রিসেন্টের ৩৪ জন। আন্তর্জাতিক তদন্তকারীদের প্রবেশাধিকার না থাকায় প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা জানা কঠিন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ল্যানসেটের গবেষণা জানায়, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি হতে পারে।
জাতিসংঘ বলছে, গাজার দুই-তৃতীয়াংশ এখন ‘নো-গো জোন’। অর্ধেকের বেশি অঞ্চল ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থা গাজার জনসংখ্যাগত ও ভৌগোলিক কাঠামো চিরতরে বদলে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। হাসপাতাল ধ্বংস, গণকবরের আবিষ্কার, রাফাহ সীমান্ত বন্ধ থাকায় চিকিৎসাহীনতায় মৃত্যু—এ দৃশ্যগুলো বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়ার কথা, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—বিশ্ব বিবেক আদৌ জেগে আছে কি?
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বিবৃতি, প্রতিবেদন ও ‘গভীর উদ্বেগ’ আজ কি শুধু টোকেনিজম? প্রতিরোধে তারা নির্বাক, প্রয়োগে অক্ষম। একের পর এক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে পক্ষপাতদুষ্ট নীরবতার দেয়ালে। আজ মানবাধিকার পরিণত হয়েছে কূটনীতির অস্ত্রে, আর কমিশন শুধু প্রতীকী—কাগুজে নিন্দা আছে, প্রতিবাদ আছে, কিন্তু কার্যকরতা নেই।
পুনর্বাসন নাকি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে পুনর্বাসনের প্রস্তাব আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। এটি শুধু রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য নয়, বরং ঔপনিবেশিক যুগের জবরদখল নীতির আধুনিক রূপ। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন, রোম সংবিধি এবং ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন অনুযায়ী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি অবৈধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। UDHR, ICCPR ও UNDRIP—সব আন্তর্জাতিক দলিলই এ ধরনের প্রস্তাবের বিপক্ষে। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, বৈশ্বিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকেও চরম হুমকির মুখে ফেলবে। পুনর্বাসন কখনোই সমাধান হতে পারে না, যদি তা হয় নির্যাতন ও অস্তিত্ব সংকটের বিনিময়ে।
আলোচনার অচলাবস্থা : গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ১৪ এপ্রিল কায়রোতে অনুষ্ঠিত ইসরায়েল-হামাস বৈঠকও ভেস্তে যায়। মিশর ও ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেছেন, এই বৈঠকে কোনো কার্যকর সমাধান বা নতুন যুদ্ধবিরতির আশা জাগেনি। জানুয়ারি থেকে ইসরায়েল আবারও সামরিক অভিযান শুরু করে, ঘোষণা দেয়—হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত তারা থামবে না। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় হামাস জানিয়ে দেয়, তারা অস্ত্র ফেলার প্রস্তাব মানবে না। তবুও আলোচনায় হামাস কিছু নমনীয়তা দেখিয়েছে। গাজা শাখার নেতা খালিল আল-হাইয়ার নেতৃত্বে তারা যুদ্ধবিরতির শর্তে অধিকসংখ্যক ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে হামাস এর বিনিময়ে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশের নিশ্চয়তা চাইছে, যা ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধের পথ খুলতে পারে।
শেষ কোথায়?
ফিলিস্তিন সংকট এখন আর শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি মানবতার চরম পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা ফিলিস্তিনিদের শ্বাসরোধ করে চলেছে। ইতিহাসের দায় যেমন বেলফোরের ওপর বর্তায়, তেমনি বর্তমানের বিবেকহীনতা জাতিসংঘের ওপরও বর্তায়। এ যুদ্ধ কবে থামবে, কেউ জানে না। এক ফিলিস্তিনি ইসমাইল আল-রাকাব বলেন, ‘আগে ঘর ছিল, এখন তাঁবুও নেই। আমরা যাব কোথায়?’ এ প্রশ্ন শুধু ইসমাইলের নয়—এটি এক জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন, ন্যায়বিচারের প্রশ্ন এবং সেসব আলোচনার দিকে ছুড়ে দেওয়া এক আর্তনাদ, যেগুলো শুধু রাজনৈতিক চাওয়া-পাওয়ার জালে আটকে থেকে মানবতাকে ভুলে যেতে বসেছে। যতদিন দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি চলবে, ততদিন আন্তর্জাতিক আইনও থাকবে প্রশ্নবিদ্ধ আর তার মাশুল দেবে সাধারণ মানুষ—তাদের পরিচয়, অধিকার ও জীবন দিয়ে।
লেখক: সংগঠক ও পরিবেশকর্মী
মন্তব্য করুন