অতীতের কিছু ফয়সালা করে ইসলামাবাদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্য ও ব্যবসার সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে চায় ঢাকা। যমুনায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচকে এ বার্তা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। বলেছেন, ‘কিছু বাধা রয়েছে। সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’
পাকিস্তানের কাছে স্বাধীনতার আগের ৪.৫২ বিলিয়ন ডলার পাওনাও চেয়েছে বাংলাদেশ। বলা হয়েছে, একাত্তরে এ অঞ্চলে চালানো গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে। দেশের অভ্যন্তরীণ পটপরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে গোটা বিষয়টি ভিন্ন উচ্চতার। টানা ১৫ বছর পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হলো। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ দেখা করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঢাকা তার খুব ভালো লেগেছে। আলোচনা চমৎকার হয়েছে। বাংলাদেশের খাবার, শপিংও খুব ভালো হয়েছে। সেইসঙ্গে আগামী ২৭-২৮ এপ্রিল পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরসূচি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
ঢাকায় ইসলামাবাদকে নিয়ে এমন আতিথেয়তার মধ্যে দিল্লির বাতাস ভিন্ন। সেখানে মুসলিমদের দুর্দশা যাচ্ছে। ওয়াকফ ব্যবস্থার সংস্কার আদালতে পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’। কংগ্রেসের কাছে সংবিধানের মূলনীতি, ধারা ও চর্চার ওপর আঘাত। বাংলাদেশ-ভারতের অভ্যন্তরীণ, দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় এখন ক্রমশই বহুপক্ষীয় হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে বহুকূটনীতি যোগ হয়ে গেছে। ভারতের প্রতিবেশীরা যার যার সক্ষমতা দেখাচ্ছে। একটা সময়ে এমন অবস্থা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন বা কোথাও সফরে গেলে সেটাও ভারতকে জিজ্ঞেস করে যেতে হতো। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একসঙ্গে এগিয়ে চলা ভারতের জন্য বড় বেদনার। কিছুটা চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিরও।
এর মাঝেও কূটনৈতিক ভাষার মারপ্যাঁচে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর বলেছেন, ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও অদ্বিতীয়। আবার এ কথাও বলে আসছেন, বাংলাদেশে মৌলবাদী প্রবণতা দেখছেন তারা। শিগগির বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন হবে, এ আশাবাদের কথাও বলতে ছাড়ছেন না। আসলে অবস্থা এখন এমন একপর্যায়ে চলে গেছে, কে কী বলছেন ঘটনা তার ওপর নির্ভর করছে না। মার্কিনি মেহমানরা বাংলাদেশ ঘুরছেন। জোড়ায় জোড়ায় সফরও করছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের সফরকালে ঢাকায় দুজন মার্কিন মন্ত্রীও ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের এসব নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ততা যাচ্ছে। বাংলাদেশ আবারও ইন্দো-মার্কিন জিও-পলিটিক্যাল ক্লায়েন্ট হচ্ছে না সত্যিকারের ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে যাচ্ছে, এ নিয়ে নানা কথা ও কূটনৈতিক ব্যাখ্যা ঘুরছে।
দিল্লি-ঢাকা দুই রাজনৈতিক মঞ্চেই এখন ভর উদ্বেগ-অস্থিরতা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার মধ্যেই ভারত এখন নতুন এক কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক সহযোগিতা ভারতের জন্য বাড়তি উদ্বেগের। চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ অক্ষ ভারতের জন্য উদ্বেগের না হয়ে পারে না। ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে তিন দেশ পরস্পরের আরও কাছাকাছি চলে আসায় চিকেন নেক নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে শিলিগুড়ি করিডোর ঝুঁকিতে পড়েছে। মাত্র ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত এই করিডর ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। এর পাশাপাশি সীমান্তে চীনের সেনা উপস্থিতি ও সামরিক তৎপরতা ভারতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
চীন এ অক্ষের মূল চালক শক্তি। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের দ্রুত অগ্রগতি ভারতকে আতঙ্কিত করছে। চীনের ২০২৫ সালের সামরিক বাজেট ২৩ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে, যা ভারতের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। চীনের হাইপারসনিক মিসাইল, অত্যাধুনিক ড্রোন প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী সাইবার যুদ্ধ সক্ষমতা তাদের আধুনিক যুদ্ধে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরে, রেল ও সড়ক যোগাযোগে চীনা বিনিয়োগকে ভারত কৌশলগতভাবে সন্দেহের চোখে দেখছে। পাকিস্তান এ অক্ষের অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। ভারতের পররাষ্ট্র ও ভূরাজনীতির জন্য বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা অত্যন্ত দামি। এ দেশগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তন ভারতের মাথাব্যথার কারণ। যার মূলে চীন। এ চারটি দেশই চীনমুখী রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাদের বেইজিংয়ের ভরসা হয়ে ওঠা ভারতকে তাড়িত-ব্যথিত করাই স্বাভাবিক।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে প্রকাশিত মাইকেল কুগেলম্যানের এক লেখায় বলা হয়েছে, সম্প্রতি সাক্ষাৎকারে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক সুরে কথা বলেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু চীনের মতিগতি ভারতের চানক্যনীতিকে মার খাইয়ে দিচ্ছে। পররাষ্ট্রসহ চীনের যাবতীয় পদক্ষেপের পেছনেই থাকে অর্থনীতির অঙ্ক। লাদাখ সংঘর্ষের পরও চীনের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। এর বিপরীতে ভারতের বৃহত্তর সামুদ্রিক এলাকায় চীনের বিশাল নৌ উপস্থিতি এবং একমাত্র বিদেশি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এশিয়া প্রভাব বিস্তারে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়েও বেইজিংয়ের সঙ্গে নয়াদিল্লির উত্তেজনা চলছে। চীনের বিদ্রোহী প্রদেশ হিসেবে চিহ্নিত তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে ভারত, যা কখনোই ভালোভাবে নেয় না চীন। বাংলাদেশ সেখানে দুই পরাশক্তি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দ্বৈরথেই চড়েছে। বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ বছরের নীতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশটি ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে। ২০২২-২৩ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্র হাসিনার স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতায় বহাল থাকার বিরোধিতা করেছে। পরে আবার হাসিনাকেই মেনে নিয়েছে। ৫ আগস্ট অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে যুক্তরাষ্ট্র নবগঠিত ইউনূস সরকারকে দ্রুত পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের একত্রে পথ চলার দীর্ঘ ২০ বছরের পুরোনো সম্পর্কের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তবে ভারত হাল ছাড়ে না। চীনের বৈদেশিক নীতি মার্কিন নীতির বিপরীত। এ বৈপরীত্যের মাঝেই চীনা পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন। চীন এখন মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সমঝোতার তৎপরতা চালাচ্ছে। চীনের এ ভূমিকায় লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারলে চীন-বাংলাদেশ আরও গভীর সম্পর্ক তৈরি হতে পারবে।
চীনের দূতিয়ালিতে এর আগে ২০২৩ সালে ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে। সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানের ক্ষেত্রে চীন তার দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষ নীতি ত্যাগ করে ভেটো প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে চীনবিরোধী কোয়াড ও ইন্দোপ্যাসিফিক জোট গঠন করেছে। তবে এ দুই জোটের এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকলেও চীনকে মোকাবিলার অভিপ্রায় থেকেই তা গঠিত হয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট অবস্থান থাকা সত্ত্বেও ১৫ বছরে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এগিয়ে গিয়েছে। হাসিনা আমলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত ঋণ প্রদান বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের এ ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র রোধ করতে পারেনি। এর কারণ বাংলাদেশের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের আর্থিক সক্ষমতা বেশি। ভারতও অধিক হারে চীনা ঋণ পেতে মুখিয়ে আছে।
বাংলাদেশের প্রয়োজন পূরণে চীনের এ সামর্থ্যকে শেখ হাসিনা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ৫ আগস্ট হাসিনার পতন হওয়া মাত্রই চীন নবগঠিত ইউনূস সরকারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের পর ১২ অক্টোবর দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশ ঘুরে যায়। হাসিনার পতনের পর চীনা কর্তৃপক্ষ হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করতে থাকে। দেশটি সফরের হিড়িক পড়ে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে। একপর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও চীনে একটি হাই-প্রোফাইল সফর করে আসেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ঘনিষ্ঠতাকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখবে? এ জিজ্ঞাসার মাঝে সম্ভাবনা-সমস্যা দুই জবাবই আছে। বিষয়টা বৈশ্বিক বাস্তবতার। নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ধারণা করা হচ্ছিল, দুনিয়া জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ও নেতৃত্ব আরও বহুকাল বিনা বাধায় চলতে থাকবে। সে সময় বলা হতে থাকে নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি শুরু হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কবলে পড়া যুক্তরাষ্ট্র সহসাই উপলব্ধি করে চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে দুই অক্ষতেই আছে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের ভূমিকায় গোলমাল হওয়ার শঙ্কা নেই। বিশেষ করে অবকাঠামোগত প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমকে বিচলিত করছে না। কারণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হলে এ দেশে পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগের পথকে সুগম ও নিষ্কণ্টক করে তুলবে না। একটা সময় পর্যন্ত এককালে মার্কিন কিংবা সোভিয়েত বলয়ের বাইরের অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্ব বলে ডাকা হতো। বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের স্থলে চীনের মুখে গ্লোবাল সাউথ নামটি ব্যাপক প্রচারিত-আলোচিত ও উচ্চারিত। এ ছাড়া হাল দুনিয়ায় ভূরাজনীতির চেয়েও ভূ-অর্থনীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বাঁকবদলের সেই সোপান বা দ্বৈরথেই চড়েছে বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন