কৃষ্ণ কুমার শর্মা
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান হাহাকার

রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান হাহাকার

ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে ‘HENRY’ (High Earners, Not Rich Yet) শ্রেণি—যারা উচ্চ আয় করেও আর্থিক চাপে থাকে এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবহেলার শিকার হচ্ছে। এই মধ্যবিত্ত পেশাজীবীরা (যেমন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আইনজীবী) উচ্চ কর, বাসস্থান সংকট, শিশু পরিচর্যার খরচ এবং সময়ের অভাবে দিশেহারা। তারা ধনী নয় যে কর ছাড় পাবে; আবার দরিদ্র নয় যে সরকারি সহায়তা পাবে। ফলে রাজনৈতিকভাবে তারা নিঃশব্দ ও প্রতিনিধিহীন। একই ধরনের ‘নীরব চাপা কষ্ট’ বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেও দৃশ্যমান, যারা অভিজাতদের মতো আড়ম্বর ছুঁতে চায়, অথচ ব্যয়ের ভারে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো যেমন হেনরিদের কথা ভাবছে না, বাংলাদেশেও এই কর্মব্যস্ত মধ্যবিত্তের নীরব আর্তি কেউ শুনছে না। এখন এই ‘হেনরি’ শ্রেণিকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালায় যুক্ত করা সময়ের দাবি। নইলে ভবিষ্যতের উন্নয়ন হবে অসম।

ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান বিভক্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে এক কণ্ঠস্বর; বিশেষভাবে নিঃশব্দ, পপুলিস্ট আওয়াজ ও দলীয় বিভেদের মধ্যে এ কণ্ঠস্বর হলো হেনরি। হেনরি কোনো একজন ব্যক্তি নয়, বরং একটি উপনাম। ধনী না হওয়া শ্রেণি; যারা একদিকে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হলেও, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটাই অবহেলিত। তারা বাহ্যিকভাবে সচ্ছল, কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবনযাত্রা চাপের মধ্যে। একটি চিত্র, যা সম্প্রতি দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এটি তাদের নিঃশব্দ সংকটগুলোকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধারণ করে।

চিত্রে এক তরুণ পেশাজীবী, যিনি একটি ভাঁজ পড়া স্যুট পরিহিত। হাতে টেকওয়ে কফি নিয়ে চলছেন। তার পায়ের চারপাশে সোনালি মুদ্রা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একটি স্ট্রোলারের মধ্যে কাঁদতে থাকা একটি শিশুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি তাড়াহুড়া করছেন—ক্লান্ত, বিভ্রান্ত। ‘হেনরির পক্ষে কে কথা বলবে?’—এই শিরোনামটি রাজনৈতিক নিঃশব্দতার সামনে একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন। এ প্রশ্ন এখন আরও জরুরি হয়ে উঠছে।

দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। কর, আবাসন ও জীবনযাত্রার খরচ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে হেনরিশ্রেণি—যারা টেক ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে জিপি, সলিসিটার ও মার্কেটিং ডিরেক্টর—ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারা অত্যধিক ধনী নয় যে, রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রাপ্য হবে। আবার এতটাই চাপের মধ্যে যে, অভিজ্ঞানী জীবনযাত্রা উপভোগ করতে পারে না এবং রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগের ফুরসতও পায় না। হেনরিরা প্রতি বছর £৭৫,০০০ থেকে £১,২৫,০০০ আয় করেন। তারা ব্রিটেনের উচ্চ কর্মক্ষম শ্রেণি—উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উৎপাদনশীল ও প্রচুর পরিমাণে কর দেন। তবে এ আয় সত্ত্বেও অনেকেই ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তাদের সন্তানের খরচ মেটাতে পেনশন ছাঁটাই করতে হয়। ক্রমাগত উদ্বেগ অনুভব করেন যে, ওপরের দিকে ওঠার আশা হয়তো শুধু এক মিথ্যা স্বপ্ন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ড. এলিজা হাগরিভস এ বিষয়ে বলেন, ‘তারা আগে যেসব সুবিধা ভোগ করত, সেগুলো আর পাচ্ছে না। তারা দীর্ঘ সময় কাজ করে, বেশি কর দেয় এবং এখনো তারা সাফল্যের যে জীবনধারা আশা করেছিল, তা অর্জন করতে পারছে না।’ এরা একটি চাপে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যেখানে রাজনৈতিক দৃশ্যপট শুধু ধনী বা দরিদ্রদের জন্যই তৈরি।

নীরব শক্তি ইউনিয়ন বা করপোরেট লবি গোষ্ঠীগুলোর মতো হেনরিদের কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর নেই। তারা খুব ব্যস্ত—দৈনন্দিন কাজ, শিশুদের খরচ এবং ৬০ ঘণ্টা কাজের চাপের মধ্যে রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত হতে, প্রতিবাদ করতে বা আবেদন জানাতে তাদের সময় নেই। দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের অধিবাসী ৩৯ বছর বয়সী একজন আইনজীবী এবং দুই সন্তানের মা প্রিয়া শর্মা বলেন, ‘আমরা একটি ক্লান্ত শ্রেণি। আমরা কাজ করি, কর দিই, ভোট দিই আর তারপর আবার মিলিয়ে যাই।’

তবু তাদের রাজনৈতিক অবজ্ঞা আরও গভীর হয়ে উঠলে এটি ব্রিটেনের রাজনৈতিক মানচিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তারা মূল শক্তির ওপর নির্ভরশীল, অনেক ক্ষেত্রেই সেবা খাত, উদ্ভাবন এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রাজনৈতিক অনুপস্থিতি: হেনরিদের কী চাওয়া? ব্যক্তিগত জেটের জন্য কর ছাড় বা সর্বজনীন সুবিধা বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই তাদের। তবে তারা চান— শিশুসেবা সমর্থন, শহুরে এলাকায় আবাসন সংস্কার, মধ্যবিত্ত পরিবারদের জন্য কর সুবিধা। এমন একটি ব্যবস্থা তারা চান, যেখানে তাদের কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বার্মিংহামের একজন ফিনটেক উদ্যোক্তা ড্যারিল লিন বলেন, ‘আমাদের জন্য কোনো ন্যারেটিভ নেই। আপনি হয় ধনী ও খারাপ অথবা দরিদ্র ও প্রাপ্য। আমরা শুধু কাজ করছি, অর্থ ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং বুঝতে পারছি না কোথায় যাচ্ছে অর্থ।

শোনার আহ্বান: চিত্রের হেনরি, মুদ্রা হারানো, শিশু ক্রন্দন, কফি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া—এটি শুধু একটি হাস্যকর চিত্র নয়। এটি একটি চিৎকারের মতো, যা স্বীকৃতির আহ্বান জানাচ্ছে। ব্রিটেন যখন অস্থির অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের মুখোমুখি, তার রাজনৈতিক শ্রেণিকে অবশ্যই শোনার চেষ্টা করতে হবে; নইলে তারা সেই জনগণকে অগ্রাহ্য করবে যারা দেশটিকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

প্রশ্নটি শুধু সমসাময়িক নয়, বরং অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে—হেনরির পক্ষে কে কথা বলবে? যে দলটি একটি সুনির্দিষ্ট ও সহানুভূতিশীল উত্তর প্রদান করবে, তারা শুধু ভোটই জিতবে না—তারা ভবিষ্যতেও জয়ী হতে পারে।

এটি স্পষ্টতই উদ্বেগের যে, ‘হেনরি’ শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব রয়েছে। কেননা এ ক্রমবর্ধমান ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীটি রাজনৈতিক আলোচনায় উপেক্ষিত হচ্ছে। তারা ধনী বা দরিদ্রের চিরাচরিত শ্রেণীকরণের মধ্যে পড়ছে না। তাদের নীরবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো এ শ্রেণির সুনির্দিষ্ট চাহিদা ও উদ্বেগের প্রতি মনোযোগ না দেয়, তবে তারা শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সমর্থনই হারাবে না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নেও বাধা সৃষ্টি করবে। সহানুভূতিশীল ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে; যা এই ‘ক্লান্ত’ মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা ও পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেবে। উৎস: দ্য ইকোনমিস্ট

লেখক: কলামনিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ফুটপাতে হকার বসার সময় নির্ধারণ করে দিলেন চসিক মেয়র

সাবেক সিআইডি প্রধানকে দুদকে তলব 

রাজশাহীর পুঠিয়ার বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুই শিশুর মৃত্যু

পারভেজ হত্যার ঘটনায় জবি ছাত্রদলের মশাল মিছিল 

দোতলা ভিসি ভবনে লিফট, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

ভারতের সহায়তা ছাড়া তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়

ডাক ও টেলিযোগাযোগ খাতের দুর্নীতি অনুসন্ধানে টাস্কফোর্স গঠন

মুগদা থানার ০৬নং ওয়ার্ডে ছাত্রদলের কর্মিসভা

দুদকের অনাপত্তিপত্র ছাড়াই থার্ড টার্মিনালের পিডি নিয়োগ

সাফল্যের ৭ বছরে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিউটি ই-কমার্স ‘চারদিকে’

১০

সিরাজগঞ্জে ট্রিপল মার্ডারের আসামি রাজীবের মৃত্যুদণ্ড

১১

মহিলা পরিষদের বিবৃতি / নারীকে আজ আর ঘরেও নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না

১২

প্রকল্পের কাজ ঠিকাদার নয়, বাংলাদেশ বান্ধব হতে হবে : দুদক চেয়ারম্যান

১৩

নরসিংদীতে ট্রেনের ধাক্কায় স্কুলছাত্রীর মৃত্যু

১৪

এলজির উদ্যোগে ‘এলজি অ্যাম্বাসেডর চ্যালেঞ্জ ২০২৫’

১৫

ওয়্যারড্রবে গুলি ও অস্ত্র রেখে দেন ইফতি, অতঃপর...

১৬

আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করলেন নুর

১৭

জামায়াতকে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী-প্রতারক’ আখ্যা বিএনপি নেতা বাচ্চুর

১৮

খেলাফত মজলিস-এনসিপির সংলাপ, ৮ দফা ঐকমত্য

১৯

নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে আবেদনের সময় বাড়ল

২০
X