‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’—দেশ চালাবার ক্ষেত্রে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিরকালের কবিতার এ অমোঘ চরণকে প্রকৃত অর্থেই ধারণ করে আছেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাবতে এবং বলতে অনেকেরই ভালো লাগে, সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি এরই মধ্যে বেশ দক্ষতার নানামুখী স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। সাত মাসের মধ্যে দেশকে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি ভারত প্রশ্নে জনগণের মনোভাবকে ড. ইউনূস পুরোটা ধারণ করেছেন বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, একটি পরিষ্কার বার্তা দিতে পেরেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তার চীন সফর মৃতসঞ্জীবনী টনিকের মতো কাজ করেছে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। বলা হয়, চীন সফরের সময় ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে মন্তব্যের প্রভাব বেইজিং আর দিল্লি পেরিয়ে ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে পৌঁছেছে, যেন বোরাকে। সামগ্রিক বিবেচনায়, সাত-আট মাসের মধ্যেই ড. ইউনূস নিজেকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। আর তাকে নিয়ে শুরুর দিকে জনবিবেচনা পেন্ডুলামের মতো থাকলেও পবিত্র রমজান মাস থেকে ইউনূস সরকারের কর্মকাণ্ড দেশের মানুষ স্বস্তির দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন। কারও কারও মতে, তিনি এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয় সরকারপ্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, এ জনপ্রিয়তাই শেষ কথা নয়; যা বাংলাদেশে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করলে এবং ক্ষমতার মমতায় মসনদ কামড়ে পড়ে থাকতে চাইলে ফলাফল ভালো হয় না। স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাত্র সরকার মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল, এর দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। এ ছাড়া প্রতিটি সরকারই বিভিন্ন মাত্রায় ধাওয়া খেয়ে ক্ষমতা ছেড়েছে। এরা ক্ষমতাসীন থাকাকালে নির্বাচন নিয়ে অনিয়ম করেছে। নির্বাচন প্রশ্নে অপরাধও করেছে বিভিন্ন মাত্রায়। এ অপরাধের ক্ষেত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়ে আছেন পতিত শেখ হাসিনা। কোন তকমা অপেক্ষা করছে ড. ইউনূসের জন্য?
জানা কথা, রাজনীতি-গণতন্ত্র-নির্বাচন, কোনোটাই পরিশীলিত অথবা প্রশ্নাতীত কোনো বিষয় নয়। আর এ কাঠামো ছাড়াও বিশ্ব চলেছে। এখনকার চেয়ে খারাপ চলেছে, তাও বলার উপায় নেই। এরপরও চলমান বিশ্ব বাস্তবতায় উল্লিখিত তিনটিই হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি, ভরকেন্দ্রও বলা চলে। এর ব্যত্যয় হলে অন্যরকম ঘটনা ঘটে, অথবা মহাশক্তির কেন্দ্র থেকে ঘটানো হয়। বিশ্বের এমন একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। আছে বাংলাদেশেও। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকা পরিবারের দুজন ছাড়া সব সদস্য এবং অনেক স্বজনসহ লাশ হয়ে ক্ষমতার মসনদ থেকে নামতে হয়েছে। প্রায় একই রকমের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। কিন্তু চলমান বিশ্ববাস্তবতার প্রভাবে লাশ হওয়ার বদলে অনেকটা পুল সুরাতের বাস্তবতায় দেশত্যাগের অভিনব পদ্ধতিতে অকল্পনীয় সুযোগ পেয়েছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। অথচ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বিশাল মহিরুহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। শেখ হাসিনা রাজনীতির কঠিন জমিনে ছুটেছেন ২১ বছর। প্রসঙ্গত, ৭৩-এর সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে নানান নগ্ন অধ্যায়ের সূচনাকারী মুজিব সরকার ডাকসু নির্বাচন নিয়েও যে কাণ্ড করেছেন, তাও কিন্তু ছোট কোনো কলঙ্কের বিষয় নয়!
পিতা-কন্যার চরম পরিণতির মাঝখানে ক্ষমতা ছাড়া প্রশ্নে প্রায় কাছাকাছি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির গেটিস নির্বাচন দিয়ে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন তিনি। অথচ ঠিক আগের মেয়াদে ১৯৯১ সালে জীবনের প্রথম নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, ৯১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্কের মডেল হয়তো বেগম জিয়া মগজে ধরে রেখেছিলেন ২০০১ সালেও। এদিকে তার প্রথম মেয়াদের আগে টানা ৯ বছরের মাথায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছেড়ে প্রাণে বাঁচলেও জেল থেকে বাঁচতে পারেননি জেনারেল এরশাদ। অথচ তার মেয়াদকালে দূরদর্শী ও দক্ষ শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আর তিনি আগের দুই শাসকের করুণ পরিণতি পাশ কাটিয়ে পায়ে হেঁটে মসনদ থেকে নামার সুযোগ পেলেও কিছুদিনের মধ্যে তাকে কারাগারে প্রবেশ করতে হয়েছে এবং তার এই কারাবাস ছিল বেশ দীর্ঘ। প্রকৃত অর্থেই কারাবাস। বেগম জিয়ার মতো আপনালয়ে কারাবাসের সৌভাগ্য হয়নি সামরিক শাসক এরশাদের। উল্লেখ্য, তাকে নির্বাচনী কেলেঙ্কারির মহা খলনায়ক মনে করা হয়। এরপরও তিনি পায়ে হেঁটে ক্ষমতা থেকে নামতে পেরেছেন, শেখ হাসিনার মতো পালাতেও হয়নি। যদিও তার পূর্বসূরি জেনারেল জিয়াউর রহমান পায়ে হেঁটে মসনদ থেকে নামার সুযোগ পাননি। অথচ জিয়াউর রহমানকে দক্ষ, সৎ, দূরদর্শী, নীতিবান ও জনপ্রিয় শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার জনপ্রিয়তায় অকাট্য প্রমাণ হয়ে আছে জানাজার বিশালত্ব। শুধু তাই নয়, ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ভয়ংকর সময়কে মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের অবদান ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদার স্থানেই থাকবে বলে বিশিষ্টজনরা মনে করেন। আর ৭৫-পরবর্তী জটিল পরিস্থিতিতে নিরন্তর কঠোরতায় সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলায় আনার অসাধ্য সাধন করেছেন জেনারেল জিয়া। এরপরও শেখ মুজিবের পরিণতিতে বিদায় নিতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসী সেক্টর কমান্ডারকে।
এদিকে নির্বাচন নিয়ে ১৯৯১-এর মতোই নেপথ্য খেলার প্রভাবে ২০০৮-এর সংসদ নিবার্চন জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতার রাজনীতিতে ইনবিল্ট প্রবণতায় আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তিনি বেপরোয়াভাবে হেঁটেছেন, অনেকটা উল্কাগতিতে। যার প্রথম নগ্ন প্রকাশ ঘটে ২০১৪ সালের নির্বাচনে। যদিও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ মনে করেন, শেখ হাসিনাকে বা খালেদা জিয়াকে অথবা দুজনকেই ফাঁদে ফেলার জন্য ২০১৪ সালের নির্বাচন কেন্দ্র করে নেপথ্য কুশীলবরা বড় খেলা খেলেছেন। যে খেলায় বিজয়ী হওয়ার বিভ্রমে নিমজ্জিত হয়ে শেখ হাসিনা জোরকদমে নতুন সর্বনাশের ফাঁদের দিকে দ্রুত এগিয়েছেন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিজের ফাঁদ আরও প্রসারিত করেছেন নিজেই। যে ফাঁদ রাজনীতির চোরাবালি তাকে গ্রাস করতে শুরু করে। ফলে চরম অসহায় হয়ে ২০২৪ সালে ‘আমি-ডামি’র অভিনব নির্বাচন করা ছাড়া তার আর কোনো পথ খোলা ছিল না এবং ২০১৪ থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনটি নির্বাচনই ৫ আগস্ট তার পরিণতিকে অনিবার্য করে দিয়েছে। এদিকে ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচন প্রশ্নে ডার্টি প্লেয়ার হয়ে ওঠাদের পরিণতির কুষ্ঠিনামা প্রসঙ্গ অতিসংক্ষেপে তুলে ধরা মোটেই অতীত রোমন্থনের আয়োজন নয়। বরং সামনের দিকে তাকানোর বিনয়ী গৌড়চন্দ্রিকা মাত্র। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচন থেকে ভোটারদের দূরে রাখার ছলাকলা করতে গিয়ে শাসকরা যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরিস্থিতির সুযোগ নেয় নেপথ্য কুশীলবরা—এটিই স্মরণ করিয়ে দেওয়া। শিশুতোষ লেখাপড়ায় একটি কথা আছে, ‘উদাহরণ সহকারে বর্ণনা করো।’ সেই রকম আরকি! তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিন্তু মোটেই শিশুতোষ অবস্থায় নেই। কখনো থাকেও না। আর বিগত ৫৪ বছরের চেয়ে চলমান সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেই সরল নয়। বরং অধিকতর কুটিল ও জটিল। ফলে নির্বাচন নিয়ে কোনোরকম ধানাই-পানাই করা হলে তার পরিণতি ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর এর সঙ্গে অমোঘ একটি সত্য হচ্ছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের মহাযজ্ঞ কেবল ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। বরং বহুলাংশে অংশীজনের ওপরও নির্ভরশীল। সঙ্গে নেপথ্য খেলোয়াড়দের প্রভাব তো থাকেই।
সবারই জানা, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের দিন মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওইদিন সন্ধ্যায় আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে প্রথম তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বারবার অনুরোধে তিনি সরকারের দায়িত্ব নিতে প্রথমে নিমরাজি হন। পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে সেই সময় আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দল ও শক্তির সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তারাও অধ্যাপক ইউনূস ছাড়া অন্য কারও নেতৃত্ব মেনে নিত কি না— সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মনে করা হয়, সেদিনকার সবার চিন্তা এবং যৌথ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কিন্তু বিদায়লগ্নের মতো রাজনীতিতে হায়নাসম শক্তির প্রত্যাবর্তন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে একই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো? এটিই হচ্ছে দেখার বিষয়। আর এ ক্ষেত্রে ছোটখাটো ভুলও মহাদুর্যোগ ডেকে আনতে পারে। অতএব সেই প্রবচন,
সাধু সাবধান!
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন