আবু তাহের খান
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৫ এএম
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে তো!

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে তো!

বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মধ্য থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে মিয়ানমার ফেরতযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার গণমাধ্যম শাখা। তদুপরি আরও ৭০ হাজারের চিহ্নিতকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে ওই শাখা থেকে জানানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চরম অনিশ্চয়তায় থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এটি নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক খবর। এখন কথা হচ্ছে, মিয়ানমারে ফেরতযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত এ রোহিঙ্গাদের বাস্তব প্রত্যাবাসন কবে থেকে শুরু হয়ে কবে নাগাদ শেষ হবে এবং অনুরূপ প্রক্রিয়ায় বাকিদের চিহ্নিতকরণ ও প্রত্যাবাসনের কাজ কবের মধ্যে সম্পন্ন হবে? আগামী বছরের ঈদের আগে সম্পন্ন হবে তো, যেটি প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় ঘোষণা করেছেন।

মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অংশবিশেষকে ফেরতযোগ্য হিসেবে চিহ্নিতকরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হতে পারে যে, উল্লিখিত শরণার্থীরা হয়তো সহসাই নিজ দেশে ফিরে যাবে। তবে সাদা চোখে এমনটি মনে হলেও আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভাষা ও মারপ্যাঁচ এতটাই জটিল ও রহস্যময় যে, প্রকৃতপক্ষে ওই শরণার্থীরা কবে স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে, তা শুধু প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হওয়ার পরই নিশ্চিত বলা সম্ভব। তবে আশা করব যে, এটি অবশ্যই প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের ঈদের আগে সম্পন্ন হবে। কিন্তু বাস্তবে হবে তো? এমনটি জিজ্ঞেস করার কারণ একাধিক, যা নিয়ে এখানে খানিকটা আলোচনা করছি।

রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে ন্যূনতম খোঁজখবর রাখেন এমন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য আরও কিছু জাতিগত সমস্যার কারণে মিয়ানমারে এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। মিয়ানমারের অন্যান্য রাজ্যের কথা বাদ দিয়ে শুধু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকানের বিষয়ে বলতে গেলেও স্বীকার করতে হবে যে, সেখানকার অবস্থা এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক নাজুক। বিদ্রোহী আরাকান লিবারেশন আর্মি (এএলএ) এবং অন্যান্য আরও কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আরাকানসহ মিয়ানমারের অন্যত্রও ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মিয়ানমারে স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা; অতঃপর সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন বস্তুত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার ওপর সেখানে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ফলে এটি আরও খানিকটা সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে বৈকি! এ অবস্থায় মিয়ানমার ফেরতযোগ্য রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরির কথা বললেও বাস্তবে এ শরণার্থীদের তারা সহসাই ফিরিয়ে নেবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যে দেশটি এই মুহূর্তে মিয়ানমারের ওপর সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হয়, সেটি হচ্ছে চীন। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরকালে এ বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাহলেও ১৩ থেকে ১৪ লাখ শরণার্থী রোহিঙ্গার সে দেশে ফিরে যেতে বেশ লম্বা একটা সময় লেগে যাবে। কারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর আগে সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেখানে এখনো অনেক কাজ করতে হবে। রাখাইন প্রদেশ এখন বলতে গেলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও লুণ্ঠন-উত্তর এক বিধ্বস্ত জনপদ, যেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার কোনো পরিবেশই নেই—ন্যূনতম নিরাপত্তা তো নেই-ই। ফলে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সেখানকার একাধিক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। উল্লেখ্য, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়িঘর, জমিজমা ও সহায়সম্পত্তির অধিকাংশই এখন অপরাপর বর্মীদের দ্বারা জবরদখল হয়ে আছে। ফলে রোহিঙ্গাদের সেখানে ফিরিয়ে নেওয়ার আগে সরকার কর্তৃক ওইসব পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার এবং দেশটির স্থানীয় জনগণের মধ্যকার একটি বড় অংশই রোহিঙ্গাদের সে দেশের স্থায়ী নাগরিক হিসেবে তো নয়ই, এমনকি রোহিঙ্গা হিসেবেও মানতে রাজি নয়। তাদের ভাষায় রোহিঙ্গারা হচ্ছে অভিবাসী মুসলমান। বস্তুত তাদের এ ধরনের আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট সংঘাতের কারণেই রোহিঙ্গাদের পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের সে দেশে ফেরত পাঠাতে হলে সর্বাগ্রে সে দেশের সরকার কর্তৃক তাদের ওই দেশের স্থায়ী নাগরিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তা দিলেই শুধু তাদের পক্ষে সে দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে। নইলে এ ধরনের প্রত্যাবাসন কখনোই স্থায়ী বা টেকসই হবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, মিয়ানমার সরকার কি সেটি করতে রাজি হবে কিংবা বিশ্বসম্প্রদায় কি তা করতে তাদের রাজি করাতে পারবে? তদুপরি এ ক্ষেত্রে এটাও মনে রাখা দরকার যে, রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে শুধু মিয়ানমারের নিজস্ব জাতিগত সমস্যাই জড়িয়ে নেই—এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশও অন্তরাল থেকে নানাভাবে কাজ করছে। ফলে বিশ্বরাজনীতির ওইসব কূটচাল অতিক্রম করে রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারকে রাজি করানোর কাজটি যথেষ্টই জটিল ও কষ্টসাধ্য।

মোটকথা, আরাকান ছেড়ে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের বিষয়টি শুধু নাফ নদী পার হয়ে পশ্চিম পাড়ে চলে আসার মতো সরল বিষয় নয় এবং তাদের ফিরে যাওয়ার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এর চেয়েও অধিক জটিলতা। তদুপরি এর সঙ্গে যুক্ত আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী পক্ষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। ফলে এরকম একটি জটিল সমীকরণের মুখে দাঁড়ানো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান রাতারাতি হয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। বিষয়টি আমরা সাধারণ মানুষ যতটা বুঝি, তার চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং তার চেয়েও অধিক বোঝেন বিশ্বসমাজের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসার অভিজ্ঞতায় হৃদ্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু এতসব বুঝেও গত ১৪ মার্চ জাতিসংঘ মহাসচিবের পাশে বসে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছি।’ (প্রথম আলো, ১৫ মার্চ, ২০২৫)। এ অবস্থায় মিয়ানমার যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরতযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করার কথা জানাল, তা ওই বক্তব্যের সঙ্গে খুবই ধারাবাহিকতাপূর্ণ। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটি কি সত্যি সত্যি ১৪ লাখ রোহিঙ্গার পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া, নাকি এদের মধ্য থেকে প্রতীকী কতিপয়কে পুনর্বাসন করে সেটিকেই সাফল্য হিসেবে দেখানোর কোনো কূটনৈতিক কৌশল?

সে যাই হোক, থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বিমসটেক সম্মেলনের পার্শ্ব বৈঠকে বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি (হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ) ড. খলিলুর রহমানকে মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী উ থান সোয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার ফেরতযোগ্য রাখাইন শরণার্থীর তালিকা তৈরির তথ্য দিয়েছেন মর্মে গণমাধ্যমকে যা জানানো হয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। আর এ ধারাবাহিকতায় ১৩ লাখ শরণার্থী রোহিঙ্গা যদি আগামী বছরের ঈদ তাদের আরাকানের নিজ বাড়িতে করতে পারে, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি হবে বিশ্ব শান্তির পক্ষে বিজয়লাভের অন্যতম বড় ঘটনা। কিন্তু বাস্তবে সত্যি সত্যি তেমনটি হয় কি না, সেটিই দেখার বিষয়।

লেখক: অ্যাজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের রেলপথ ব্লকেড কর্মসূচি আজ

আল-আকসার ভাগাভাগি শুরু?

মাছ ধরতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে চাচা-ভাতিজার মৃত্যু

দুপুরের মধ্যে ঢাকায় ৬০ কিমি বেগে বজ্রবৃষ্টির আভাস

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মারা গেলেন ছোট ভাই

১৫ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বৈঠক আজ

পাবিপ্রবিতে জাতীয় ব্যবসা উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

ইসরায়েলি হামলা / আরও ৩৫ মৃত্যু, নতুন করে ঘরছাড়া ৫ লাখ মানুষ

১০

১৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১১

১৭ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১২

চবির পাঁচ শিক্ষার্থীসহ ছয়জনকে অপহরণ

১৩

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট / হিন্দু বোর্ডে মুসলিম নেই, ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু থাকবে কেন?

১৪

পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে ইরান!

১৫

ক্লাসরুম ঠান্ডা রাখতে গোবরের প্রলেপ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে!

১৬

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে কে কার মুখোমুখি?

১৭

নব্য আওয়ামী লীগের রূপরেখা : ভারতের বার্তা ও নেতাদের পরিকল্পনা

১৮

সান সিরোতে মহাকাব্য, বায়ার্নকে টপকে সেমিতে ইন্টার

১৯

বার্নাব্যুর ম্যাজিকে কাজ হলো না, ঘরের মাঠে হেরে বিদায় রিয়ালের

২০
X