১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর পতনের পর, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের প্রায় এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন আবারও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্সির মাত্র দুই মাস অতিবাহিত হতে না হতেই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক কায়া কাল্লাস বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় এমন বড় মাপের পরিবর্তন আসতে চলেছে, যা ১৯৪৫ সালের পর আর দেখা যায়নি।’ কিন্তু এই ‘বিশ্বব্যবস্থা’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? কীভাবে এটা বিঘ্নিত হয়? আর তাকে স্থিতিশীল করার উপায়ইবা কী?
কার্যত ব্যবহারিক ভাষায় ‘ব্যবস্থা’ বলতে বিভিন্ন বস্তু, কার্যাবলি ও সম্পর্কের মধ্যে স্থিতিশীল বিন্যাসকে বোঝানো হয়। যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ব্যবস্থা বলতে মৌলিক পর্যায়ে সরকার এবং তার পরিচালিত সমাজের শৃঙ্খলতাকে বোঝায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো সার্বিক ক্ষমতাধর একক সরকার নেই। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বন্দোবস্ত সর্বদা পরিবর্তনশীল হওয়ায় বৈশ্বিক রাজনীতির ধারাটা বলতে গেলে নৈরাজ্যপূর্ণ।
তবে বলে রাখা দরকার, নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা দুটো এক জিনিস নয়। ‘সুব্যবস্থা’ ব্যাপারটা মূলত আপেক্ষিক। এটা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। একটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সীমিত পরিসরে নিয়ন্ত্রণহীন সহিংসতা থাকলেও সার্বিকভাবে দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা টিকে থাকতে পারে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে— হোক সেটা সংগঠিত বা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু দেশের ভেতরে সহিংসতার মাত্রা যখন এমন উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে, তা শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে আর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না, তখন সেই দেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বলে। দৃষ্টান্তস্বরূপ সোমালিয়ার অবস্থা বিবেচনায় আনা যায়। দেশটির জনগণের মধ্যে ভাষা ও জাতিগত পরিচয়ের সামঞ্জস্য থাকলেও সেখানে গোত্রগুলোর মধ্যে দীর্ঘকাল সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। রাজধানী মগাদিশুর বাইরে দেশটির জাতীয় সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বা প্রভাব খাটাতে পারে না।
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিক রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এমন এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, যার শাসকগোষ্ঠীর বৈধভাবে বলপ্রয়োগ করার ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু শাসকের বৈধতা নির্ভর করে ‘বৈধ শাসক’ বলতে আমরা কী বুঝি, সেই ধারণার ওপর। শাসকের বৈধতা নির্ধারণ করার নীতিমালা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে। কাজেই দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অপরাধের ধরন ও সহিংসতার মাত্রা, কার্যকর নীতিমালার ওপর জনগণের আস্থা—এ সবকিছুর ওপর শাসকের ক্ষমতা চর্চার বৈধতা নির্ভর করে।
বর্তমানকালে বৈশ্বিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমরা শক্তির ভারসাম্য এবং ক্ষমতার পরিবর্তন সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। একইভাবে আমরা বিশ্বব্যাপী সহিংস ঘটনার ধরন, মাত্রা এবং কারণও বিশ্লেষণ করতে পারি। প্রায়ই যেসব যুদ্ধের মাধ্যমে দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার স্থিতিশীল বণ্টন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই যুদ্ধগুলোর মাধ্যমেই বিশ্ববাসীর কাছে শক্তির ভারসাম্যের ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে যুদ্ধের বৈধতার ওপর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে দেখা গেছে। যেমন অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের ইচ্ছা হলো পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রিয়ার সাইলেসিয়া প্রদেশ দখল করে নিতে। যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। তিনি প্রতিবেশী দেশের এ অঞ্চল নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এটা সম্ভব নয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে জাতিসংঘ গঠন করে। আর এ জাতিসংঘ কেবল প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধকে বৈধতা দান করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ব্যতীত কোনো রাষ্ট্রেরই অন্য রাষ্ট্রের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করার বৈধতা নেই।
এজন্যই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তার ভূখণ্ডের কিছু অঞ্চল দখল করে নেন। তখন তিনি দাবি করেন যে, তার এ যুদ্ধ একটি প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রুখে দেওয়ার জন্যই তিনি এ আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বলে জানান সবাইকে। তবুও জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য তার এ পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। যারা তার বিপক্ষে ভোট দেয়নি যেমন চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান; তারা মূলত আমেরিকার বিরুদ্ধ রাষ্ট্রগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তোলার পক্ষপাতী।
আন্তর্জাতিক আদালতসমূহে এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারলেও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য আদালতগুলোর নেই। অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হাতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য সমষ্টিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ থাকলেও এ সুযোগের সদ্ব্যবহার তারা খুব কম ক্ষেত্রেই করেছে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন—প্রত্যেকের কাছে ভেটো প্রয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে। তারা কেউই বস্তুত বড় পরিসরে যুদ্ধ শুরু করতে আগ্রহী নয়। তাদের ভেটো ক্ষমতাটা তাই একটা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকারের মতো কাজ করে। ব্যাপারটা এমন যে, পুরো বাড়ি পুড়ে যাওয়ার চেয়ে বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভালো।
তদুপরি চলমান বিশ্বব্যবস্থার আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা বা দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে যে পরিবর্তনগুলো বড় রকমের ভূমিকা পালন করতে পারে, তার মধ্যে একটা হলো প্রযুক্তির অগ্রগতি। এটি যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো রাষ্ট্রের সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তিকে বৃদ্ধি করে দিতে পারে। আবার দেশের অভ্যন্তরে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশটির পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন আদর্শের উত্থান বা বিপ্লবী আন্দোলনের মতো ঘটনা প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হলে, তা অল্প সময়ের মধ্যেই সরকার বা ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ইতি টানতে পারে।
যেমন, ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির কারণে কয়েক শতাব্দী ধরে চলমান ইউরোপের ধর্মযুদ্ধগুলো রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিগুলোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়ে যায়। এজন্য যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এবং তাদের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণেই মিত্রশক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করে। পরবর্তীকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ‘লিগ অব নেশন’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলেও আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তিনি তা করতে সক্ষম হননি। আমেরিকা সেই সময় বিচ্ছিন্নতাবাদের নীতি অবলম্বন করে। সেজন্য পরে ১৯৩০ এর দশকে অক্ষশক্তি ইউরোপসহ বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। তবে তার সামরিক শক্তিকে টেক্কা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তার পর্যাপ্ত ভূমিকা ছিল না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাময়িককালের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার সুবিধাগুলো ভোগ করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়ায় এবং আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য অনেকটাই কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের পতন ঘটতে শুরু করেছে মনে করে রাশিয়া ও চীন তাদের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করে ফেলে। পুতিন প্রতিবেশী রাষ্ট্র জর্জিয়ার ওপর আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেয় এবং চীন দেন জিয়াওপিংয়ের রক্ষণশীল নীতি পরিবর্তন করে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি চর্চা করতে শুরু করে। একই সময়ে চীনের গতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তাকে আমেরিকার সঙ্গে শক্তির ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে সক্ষম করেছে।
এ কথা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি আপেক্ষিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে এখনো তার ২৫ শতাংশ অংশীদারত্ব রয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন সম্মিলিতভাবে ২০ শতাংশের অংশীদার। তবে জাপান ও ইউরোপের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখতে পারলে এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির অর্ধেকেরও বেশি অংশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কি আমেরিকার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আগের মতো সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে? নাকি কায়া কাল্লাসের সে কথাটাই ফলবে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোড় ঘুরতে শুরু করেছে? ১৯৪৫, ১৯৯১ আর ২০০৮ সালে বিশ্বব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এ তালিকায় যদি ২০২৫ সালকে যোগ করতে হয়, তবে তা করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রনীতির জন্য, যা তার জন্য অমঙ্গলকর বলেও প্রমাণিত হতে পারে। তবে একটা কথা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়—চলমান এ পরিবর্তনটা কোনো স্বাভাবিক রাজনৈতিক গতিধারার দৃষ্টান্ত নয়।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষা সচিব, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ এবং ‘এ লাইফ ইন দি আমেরিকান সেনচুরি’ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের লেখক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন