প্রায় দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মচ্ছব চলেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। দেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গত বছরের ডিসেম্বরে অর্থ পাচারের যে তথ্য তুলে ধরেছিল, তাকে মচ্ছব ছাড়া আর কীইবা বলা যায়। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে!
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তখন বলেছিল, দেশে গত পনেরো বছরে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। এ সময় ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। কারা বেশি দুর্নীতিবাজ ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান তখন বলেছিলেন, কমিটি বিষয়টি নিয়ে যেসব শুনানি করেছে সেখানে এমন মত এসেছে যে, ‘চোরতন্ত্রের মূল স্তম্ভ ছিল আমলা, সামরিক ও বেসামরিক উভয়ই’।
রোববার কালবেলায় অর্থ পাচারসংক্রান্ত ‘সরকারি চাকরিজীবীদের দ্বৈত নাগরিকত্ব কৌশল’ শীর্ষক প্রধান শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরে প্রায় এক হাজার সরকারি চাকরিজীবীকে শনাক্ত করেছে, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। পাশাপাশি দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সরকারি চাকরিজীবীদের তালিকা চেয়ে চারটি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুদক। অর্থাৎ এসব দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা চাকরিজীবী অবৈধভাবে উপার্জনের টাকা দেশের বাইরে পাচার করেন। আর এ দ্বৈত নাগরিকত্ব পেতে তারা নানারকমের অবৈধ পন্থা ও ছলাকলার আশ্রয় নেন।
দুদক সূত্র বলছে, যে এক হাজার সরকারি কর্মকর্তার বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে, তারা পুলিশ, বিআরটিএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজউক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরিরত। এ ছাড়া দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ডজন শিক্ষকও রয়েছেন এ তালিকায়। এরই মধ্যে চার দপ্তরে দুদক চিঠি দিয়েছে। এসব হলো—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি), ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। দুদকের পরিচালিত বিভিন্ন অনুসন্ধানের সময় এ মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে যে, সরকারি কর্মচারীদের একাধিক পাসপোর্ট নেওয়ার মূল লক্ষ্যই হলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত তাদের অবৈধ সম্পদ গোপন করে বিদেশে পাচার ও ভোগ করা। তাদের এমন কার্যকলাপ দেশে দুর্নীতির প্রসারে ভূমিকা রাখছে এবং দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কোনো দ্বৈত নাগরিক সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারেন না। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকায় বাংলাদেশের আইনে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে এবার দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সরকারি চাকরিজীবীদের সন্ধানে নেমেছে দুদক।
আমরা মনে করি, সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যারা এসব অপকর্মে জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। কেননা দুর্নীতি এবং দুর্নীতির টাকা পাচারের লক্ষ্যে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ শুধু আইনবিরুদ্ধই নয়; এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিহীনতা ও দেশের সঙ্গে বেইমানি। আমরা দুদকের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের প্রত্যাশা, দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারী এসব সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে অতিসত্তর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন