মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৩৯ এএম
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রসঙ্গ সামাজিক অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণ

প্রসঙ্গ সামাজিক অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণ

মানুষ মাত্রই মর্যাদাবান। মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্নকারক ও ঘৃণ্য যৌনাচরণ হচ্ছে ধর্ষণ। বর্তমান সময়ের এক জটিল সামাজিক সমস্যা হচ্ছে ধর্ষণ। সমস্যাটি জাতীয় জীবনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু কোনো ব্যক্তির ওপর নিপীড়ন নয় বরং গোটা সমাজব্যবস্থার ওপর আক্রমণ, যা মানুষের মৌলিক অধিকার ও সম্মান বিনষ্ট করে। সমাজের সব নারী, শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও প্রান্তিকসহ প্রত্যেকে চায় ন্যায্য মর্যাদা। নাগরিক হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান প্রত্যেকেরই কাম্য। সমাজে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে অন্যতম ধর্ষণ। সম্প্রতি দেশে ধর্ষণ নিয়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে পরিবার, পাড়া-মহল্লা, অফিস-আদালতসহ সর্বত্র। কিন্তু কেন জাতির সামনে ধর্ষণের এ বীভৎস চিত্র! এ নিবন্ধের প্রাসঙ্গিকতা সামাজিক অবক্ষয়, ধর্ষণের ক্রমবৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণের উপায়-সংশ্লিষ্ট।

নারী ও শিশু ধর্ষণ একটি নৈতিক অবক্ষয়জনিত সামাজিক অপরাধ। এরূপ একটি বেদনাদায়ক সংবাদ গণমাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় প্রচারিত হয়েছে। মাগুরার আট বছরের কন্যাশিশু নিষ্ঠুরভাবে হয়েছে ধর্ষণের শিকার। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে শিশুটি মৃত্যুর কাছে হেরে যায়। জীবন ও জগৎ দেখার আগেই নিষ্পাপ শিশুটির জীবন অবসান হয়।

শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী নানাভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি হতে অন্তঃসত্ত্বা নারী, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী কিংবা চার বছরের শিশু কারও যেন রক্ষা নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত ধর্ষণের খবর সংবাদমাধ্যম প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনা যৌনবাদের সাম্প্রতিক চিত্র। এসব নগ্নতা নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা বিধান এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে সামাজিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদনে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কমবয়সী শিশু। চলতি বছর প্রথম দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার ১০৭ জন। যার মধ্যে ৬৬ জন শিশু। চলতি বছর জানুয়ারি পর্যন্ত দায়ের করা মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৪৪০টি। বাস্তবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অনেক বেশি। কারণ অনেক ভিকটিম ও পরিবার সামাজিক লজ্জা, হুমকি ও বিচারহীনতার কারণে মামলা করতে চায় না।

দেশের সমাজব্যবস্থায় ধর্ষণ একটি চিহ্নিত সামাজিক অপরাধ। ধর্ষণ ও ধর্ষণের শাস্তির বিধানাবলি উল্লেখ আছে ১৮৬০ সালের ‘দণ্ডবিধি’র ৩৭৫ নম্বর ধারায়। তা ছাড়া বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নমূলক আইন হচ্ছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত)’। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ নম্বর ধারায় ধর্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যদি কোন পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।” ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইনে শাস্তির বিধান অত্যন্ত কঠিন। আইনের বিধানমতে, কেউ ধর্ষণের শিকার, ভিকটিম মারা গেলে, দলগত ধর্ষণের শিকার ও ধর্ষণের প্রচেষ্টার জন্য পৃথক পৃথক শাস্তির বিধান আছে। এ ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান হচ্ছে—মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০-৫ বছর সাজা ইত্যাদি। দেশে ধর্ষণের অভিযোগে অনেক মামলা হয়। কিন্তু দায়ের হওয়া মামলা যথাসময়ে সম্পন্ন হয় না। সাক্ষীর অনুপস্থিতি, বিলম্বে প্রতিবেদন পেশ, বাদীর সময় প্রার্থনাসহ বিবিধ কারণে বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ফলে ধর্ষণের শাস্তির হার খুবই মন্থর।

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা শুধু বাংলাদেশের সংকট নয়; বরং বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএন উইমেন নারীর প্রতি এরূপ চলমান সহিংসতাকে ‘শ্যাডো প্যানডেমিক বা ছায়া মহামারি’ বলে উল্লেখ করেছে। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও স্নায়ু বিশেষজ্ঞ সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৯২৯ সালে জার্মান ভাষায় একটি বই লেখেন। বইয়ের নাম Das Unbehagen in der Kultur। এর ইংরেজি অনুবাদ করা হয় Civilization and its Discontents শিরোনামে এবং বাংলা অনুবাদ হতে পারে ‘সভ্যতা ও তার অসন্তুষ্টি’। এ গ্রন্থে মানুষের যৌনাচারের মনস্তাত্ত্বিক কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। স্নায়ু বিশেষজ্ঞ ফ্রয়েডের মতে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সুখ অনুভব করা। প্রশ্ন, মানুষ কীভাবে সুখে থাকে? প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ হলে মানুষ সুখে থাকে। সভ্যতা নানান রকম নিয়মনীতির শিক্ষা দিয়ে মানুষকে সেই সুখ লাভ থেকে বিরত রাখে। পুরুষের সব তাড়না যৌন তাড়না দ্বারা পরিচালিত। সুখ লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকেই অন্য সব চাহিদার উদ্রেক হয়। মানুষ সুখের অভাব থেকে কষ্ট তৈরি হয়, স্বার্থপর হয় ও অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। ফ্রয়েড তার ‘সিভিলাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস’ বইয়ে মানুষের মধ্যে বিরাজমান ‘মহাসামুদ্রিক’ অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছেন। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রবৃত্তির তাড়নার চাহিদা পূরণে সুখ অনুভব করে। ফ্রয়েড এ প্রবৃত্তির তাড়নাকে বলেছেন ‘ইভ’। মানুষ এ ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ও নিয়মনীতি মানতে চায় না। সভ্যতার শিক্ষা মানুষের মধ্যে বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা তৈরি করে। ফ্রয়েড একে বলেছেন ‘সুপার-ইগো’ (Super ego)। অন্যদিকে ‘ইগো’ মানুষের এই দ্বৈত সত্তার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে। যাকে বলা হয় বিবেক। মানুষ এ শিক্ষা রপ্ত করে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও গণমাধ্যম হতে।

বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণ একটি অন্যতম সামাজিক ব্যাধি। ধর্ষণের শিকার শুধু কন্যাশিশু নয়, ছেলেশিশুরাও। শিশুদের প্রতি বর্বর যৌনাচরণ সমাজের একটি নগ্নরূপ। আতঙ্কের বিষয়, বেশিরভাগ শিশু যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পরিচিতজনদের দ্বারাই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক নিবন্ধ অনুযায়ী, শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী শিশুর পরিচিত ও নিকট আত্মীয় হন। শিশুদের প্রতি পুরুষদের যৌন ইচ্ছা অনুভব হচ্ছে কেন? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, এরূপ পুরুষরা ‘পিডোফাইল’ হিসেবে অবিহিত। বিষয়টি সাইক্রিয়াটিক ডিজঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত। কানাডার মানসিক স্বাস্থ্য গবেষক ড. জেমস ক্যান্টার শিশু যৌন নির্যাতনকারীদের বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। ড. ক্যান্টের গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণ মানুষ শিশুদের দেখলে আদর করে এবং ভাব জমানোর চেষ্টা করে। পিডোফাইলদের মধ্যে সে ধরনের প্রবণতা জাগে না। শিশুদের দেখলে তাদের মধ্যে যৌন প্রবণতা সৃষ্টি হয়। পিডোফাইলদের চিহ্নিত করতে হবে। শিশুদের সুরক্ষায় অধিকতর সতর্ক হতে হবে তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে।

ধর্ষণ একটি ঘৃণ্য মানবাচরণ। এ পরিস্থিতিতে বিব্রত গোটা সমাজব্যবস্থা। কুরুচিপূর্ণ মানুষগুলো প্রবৃত্তির তাড়নায় অশ্লীল পথ অবলম্বন করছে। আজ নারী, কিশোরী, কন্যাশিশু; এমনকি ছেলেশিশুও যৌন নিপীড়কদের শিকার হচ্ছে। আদিম চিন্তার পুরুষরা ধর্ষণচর্চায় সমাজ কলুষিত করছে। ধর্ষকরা সমাজের বর্ণচোরা। এসব হীন চরিত্রের ব্যক্তিরা সমাজ ও সভ্যতার প্রতি আনুগত্যশীল নয়। তারা সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে। সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে। তাই ধর্ষণ প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। পরিবার, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা জোরদার করতে হবে। যে কোনো নারীর শ্লীলতাহানি ও নিষ্পাপ শিশুর প্রতি বর্বরতায় গোটা সমাজ লজ্জিত হয়। এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ব্যক্তিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। সমাজে বসবাসকারী সবার প্রতি শোভন আচরণ এবং পারস্পরিক আস্থা জোরদার হোক। সমাজ থেকে যৌনবাদ নির্মূল হোক।

লেখক: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, আগারগাঁও, ঢাকা এবং এমএসএস (সমাজকল্যাণ) ঢাবি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের রেলপথ ব্লকেড কর্মসূচি আজ

আল-আকসার ভাগাভাগি শুরু?

মাছ ধরতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে চাচা-ভাতিজার মৃত্যু

দুপুরের মধ্যে ঢাকায় ৬০ কিমি বেগে বজ্রবৃষ্টির আভাস

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মারা গেলেন ছোট ভাই

১৫ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বৈঠক আজ

পাবিপ্রবিতে জাতীয় ব্যবসা উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

ইসরায়েলি হামলা / আরও ৩৫ মৃত্যু, নতুন করে ঘরছাড়া ৫ লাখ মানুষ

১০

১৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১১

১৭ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১২

চবির পাঁচ শিক্ষার্থীসহ ছয়জনকে অপহরণ

১৩

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট / হিন্দু বোর্ডে মুসলিম নেই, ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু থাকবে কেন?

১৪

পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে ইরান!

১৫

ক্লাসরুম ঠান্ডা রাখতে গোবরের প্রলেপ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে!

১৬

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে কে কার মুখোমুখি?

১৭

নব্য আওয়ামী লীগের রূপরেখা : ভারতের বার্তা ও নেতাদের পরিকল্পনা

১৮

সান সিরোতে মহাকাব্য, বায়ার্নকে টপকে সেমিতে ইন্টার

১৯

বার্নাব্যুর ম্যাজিকে কাজ হলো না, ঘরের মাঠে হেরে বিদায় রিয়ালের

২০
X