একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না—এই প্রবাদটি আমরা সবাই জানি। অথচ আমাদের দেশে সেই দুর্ঘটনাই ঘটছে অহরহ, অবিরত। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলছে। প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে সড়ক। ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। প্রতিদিন টিভি বা পত্রিকার পাতা উল্টালে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার খবর চোখে পড়ে। দুর্ঘটনা রোধে আইনকানুন ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। এই আনন্দ বাড়িয়ে দেয় প্রিয়জনের সান্নিধ্য। প্রিয়জনের সঙ্গে উৎসবের আমেজ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে ছুটে চলা মানুষের আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে সড়ক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় প্রতি বছরই হারিয়ে যায় অনেক পরিবারের আপনজন।
শুধু ঈদের দিন আট জেলায় সড়কে ঝরে যায় ১৬টি প্রাণ। অথচ সড়ক-মহাসড়কে সেদিন গাড়ি ছিল খুবই কম। সব মিলে ঈদের ছুটি শেষে হিসাব করলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা হয়তো শত ছাড়িয়ে যাবে। বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫৭৮ জন। আহত হন কমপক্ষে ১ হাজার ৩২৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৭৮ ও শিশু ৮৭ জন। আর জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ৬২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৮ জন নিহতের তথ্য দিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ওই মাসে অন্তত ১ হাজার ১০০ জন আহত হন। নিহতের মধ্যে নারী ৭২, শিশু ৮৪ জন। ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৬৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়িচালকদের বেপরোয়া মনোভাব। গাড়িচালকরা যখন গাড়ির স্টিয়ারিংটা ধরেন, তখন তারা নিজেদের রাজা ভাবেন। গতির নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা সত্ত্বেও তারা তা মানতে নারাজ। কেউ কেউ তো আছে যারা মদ পান করেই গাড়ি চালায়। ফলে জরুরি অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। গত শুক্রবার আব্দুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ টোল প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বলে দেয় চালকদের এমন চিত্র।
আমাদের একটি কমন বিষয় হচ্ছে, যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করা। অনেক মানুষ আছে, যারা গাড়ি কিনে টাকার জন্য ভাড়া দেয়। কিন্তু যে গাড়িটি নিয়ে যায় সে অদক্ষ, মাদকাসক্ত, অপ্রাপ্তবয়স্ক হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চালকের মাথায় একটি কথাই ঘুরপাক খায়, প্রথমে মালিকের টাকা পরিশোধ করা, তারপর নিজের জন্য আয়। এই কারণে স্বাভাবিকভাবেই তারা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। এভাবেও অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, রাস্তায় গাড়িচালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যায়, এ কারণেও ঘটে অনেক সড়ক দুর্ঘটনা এবং ফলস্বরূপ মৃত্যু। আমার মনে হয়, আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার ফলেও বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। তবে কতজন-ই বা আইন মানে! পথচারী কিংবা চালক, কেউ-ই মানতে চায় না আইন। এভাবেই নীরবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ। এর দায়ভার কাদের! আর কত প্রাণ শেষ হলে আমরা সতর্ক হব। প্রতিনিয়ত সড়ক রক্তাক্ত হচ্ছে কেন!
তবে আমরা সড়কে আর মৃত্যু দেখতে চাই না। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে সিটবেল্ট বাঁধাতে হবে। নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য মনোযোগ থাকতে হবে। একটু অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের কারণে ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। কারণ, বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য।
এখনই সময় সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে কথা বলার। হুটহাট গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানোর ফলে বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা আমরা গতকাল আব্দুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ টোল প্লাজায় একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখেছি। তাই গাড়ির গতি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনেক সময় ওভারটেকিং করার জন্য প্রতিযোগিতা করে ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। প্রতিটি গাড়ির দুটি লুকিং গ্লাস থাকতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় অনেক চালক নেশাগ্রস্ত থাকার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। আবার এ ব্যাপারে যেসব আইন আছে, তা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর—এটি একটি বড় প্রশ্ন।
সড়ক পরিবহন আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তবে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অসতর্কতা এবং অসচেতনতার জন্য দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তাই শুধু আইনের বাস্তবায়ন নয়, নাগরিকদের সচেতনতা সেইসঙ্গে কর্তৃপক্ষ, চালক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই আসুন সর্বদা নিজে সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি এবং সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করি।
সাকিবুল হাছান
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
মন্তব্য করুন