আলম রায়হান
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৩৯ এএম
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এত ভালো ভালো না!

এত ভালো ভালো না!

প্রচলিত গল্পটি এরকম, কদম আলীর সন্তান মদন আলী বিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। এ ঘটনায় গ্রাম্য মতলববাজরা বলতে শুরু করল, আরে দূর, কদমের ছাওয়াল আবার স্কুলে ভর্তি হয়! লেখাপড়া হবে না। দেখা গেল, কদমের ছেলে লেখাপড়া করছে। তখন বলা হলো, লেখাপড়া করলে কী হবে দাদা, পরীক্ষায় পাস করতে পারবে নাকি! মদন আলী নির্ধারিত সময়ে প্রতিটি পরীক্ষায় পাসও করল। তখন বলা হলো, পাস করলে কী হবেরে চাচা! চাকরি তো পাবে না। (সেই জামানায় চাকরি পাওয়াটাই ছিল লেখাপড়ার একমাত্র লক্ষ্য)। দেখা গেল, কদমের ছেলে চাকরিও পেল। তখন বলা হলো, চাকরি পেলে কী হবে! মাইনে পাবে না!! নির্ধারিত সময়ে যথারীতি মাইনেও পেল। তখন বলা হলো, টাকা কোনো ব্যাপারই না, টাকা তো গুইলেরও (গুইসাপ) আছে। দেখবা, উন্নতি হবে না! কদম আলীর ছেলের উন্নতিও হলো। তখনো হাল ছাড়েনি মতলববাজ মহল এবং যথারীতি চূড়ান্ত এক বয়ান দিল। চূড়ান্ত সেই একবাক্যে বয়ান প্রসঙ্গে আসছি কলামের শেষ অংশে। এর আগে পরিস্থিতি অনুধাবনে ড. ইউনূস সরকার প্রসঙ্গে আসা যাক।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের অকল্পনীয় পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাকে ফরাসি থেকে উড়িয়ে এনে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পাইলট রাজীব গান্ধীকে ভারত সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে বেশ মিল আছে। তবে বেশ পার্থক্যও আছে দেশের পরিস্থিতির মাপকাঠিতে। রাজীব গান্ধী যখন দায়িত্ব নেন তখন তার মা ইন্দরা গান্ধী ইহলোকে ছিলেন না, বাকি সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ড. ইউনূস এমন একসময়ে দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন কোনো কিছুই ঠিক ছিল না। দেশের শাসন ব্যবস্থা কার্যত অচল এবং প্রশাসনের সবাই পতিত সরকারের কেবলায় সেজদারত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদভ্রান্ত, ৪৬০টি থানা ভস্মীভূত, প্রথম থেকে শীর্ষ ধাপ পর্যন্ত বহু পুলিশ সদস্য পলাতক, অনেকে নিহত। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান সংস্থা পুলিশ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যত এখনো অনুপস্থিত। সর্বত্র ছিল চরম বিশৃঙ্খলা, সর্বগ্রাসী অরাজকতা। ইউনূস সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাঠামো বলতে আসলে কোনো কিছুই ছিল না। অর্থনীতি ছিল খাদের কিনারে। জনজীবনে ছিল সীমাহীন অনিশ্চয়তা। বিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে ড. ইউনূসকে শুরু করতে হয়েছে।

কারোরই অজানা নয়, দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। শুরুর দিকে বন্যার তাণ্ডবে পূর্বাঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এদিকে মুহাম্মদ ইউনূস যাদের নিয়ে সরকার গঠন করেন, তাদের বেশিরভাগই রাজনীতি ও প্রশাসনের বাইরের লোক। স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বয়স, অভিজ্ঞতার কারণেও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সবার কাজের দক্ষতা একই রকম নয়। কয়েকজন নিজের মন্ত্রণালয় চালানোর ক্ষেত্রে গ্রেসমার্কে উতরে গেলেও, কারও কারও বেশ ঘাটতি আছে। কোনো কোনো উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তা হতাশাজনক। এমনটাই অনেকে মনে করেন। বিভিন্ন মহলে জোর সমালোচনা আছে, অন্তর্বর্তী সরকার ঠিকমতো দেশ চালাতে পারছে না। এই সমালোচনা একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না। খোদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসই তো স্বীকার করেছেন, দেশ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা তার নিজের অথবা তার সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টার নেই। কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রধান পদে মুহাম্মদ ইউনূসের বিকল্প কারও কথা ভাবার সুযোগ ছিল? অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল ও পক্ষকে এক টেবিলে বসানো। সেই কাজে তারা মোটামুটি সফল হয়েছেন। এরপরও অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা আছে। সমালোচনা থাকাটাই স্বাভাবিক। এ সত্ত্বেও ইউনূস সরকারের প্রধান দুটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করা যায়। এক. সমন্বিত কার্যক্রম। অতীতের প্রায় সব সরকারই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ‘হুজুর অথবা হুজরাইন’ না বললে কিছুই হওয়ার নয়। সেই ধারা থেকে সরকার ব্যবস্থা অনেকটাই উঠে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা স্বাধীনভাবেই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন। দুই. বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা নিয়ে যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোয় এটি অনেক অভূতপূর্ব বিষয়, অনেকটা সোনার পাথর বাটির মতো।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ এবং অভাবনীয় বিষয় হচ্ছে, ৫ আগস্টের পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর স্পষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তারা বেসামরিক প্রশাসনে নাক গলায়নি। সেনাবাহিনী বেসামরিক সরকারকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এটিও ড. ইউনূস ছাড়া সম্ভব হতো? এ বিষয়েও যথেষ্ট সংশয় থাকারই কথা। এরপরও সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান কেন্দ্রিক নানা রকম প্রচারণা ও উসকানি দেওয়া হয়েছে একাধিক মহল থেকে। কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করাবার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এ হচ্ছে দেশকে নতুন করে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার অপপ্রয়াস। আরও অনেক খেলা ছিল, আছে, এবং থাকবে। এরপরও কয়েক মাস ধরে বাজার অস্থিতিশীল থাকার পর সম্প্রতি বেশ নিম্নগামী হয়েছে। রোজায় নিত্যপণ্যের দাম কল্পনাতীতভাবে নিয়ন্ত্রণেই ছিল। যেমনটি বিগত কোনো সরকারের আমলেই দেখা যায়নি। রিজার্ভ এবং খাদ্যের মজুতও সন্তোষজনক বলে মনে করা হয়। অথচ আশঙ্কা করা হচ্ছিল, রমজানে দ্রব্যমূল্যের আগুন আকাশ ছোঁবে এবং ঈদের প্রাক্কালে সবকিছু হযবরল হয়ে যাবে। বিশেষ করে ঈদযাত্রা ব্যবস্থাপনা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে। কিন্তু এই আশঙ্কার কোনোটিই ঘটেনি। বরং কল্পনাতীত প্রশান্তিতে মানুষ নাড়ির টানে বাড়ি যেতে পেরেছে। কর্মস্থলে ফিরেছেও একই ধারায়। আর আইনশৃঙ্খলা ছিল অভূতপূর্ব। এ ক্ষেত্রে রাজধানীসহ সারা দেশে এলিট ফোর্স র্যাবের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে রাজধানীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান ২৯ মার্চ গভীর রাতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে বিশেষ ফলোদয় হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার জন্য র্যাব ডিজি জানিয়েছেন, ‘র্যাবের বোম ডিসপোজাল ও ডগ স্কোয়াড প্রস্তুত, চলবে সার্বক্ষণিক মনিটরিং।’ এ সময় র্যাব ডিজি এও বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উৎসবমুখর ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে আগত নারীদের উত্ত্যক্ত, ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি রোধে মোবাইল কোর্টসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ আর শুধু বলা নয়, র্যাব যে কাজও করেছে, তা প্রমাণিত, যা সাধারণেরও নজর কেড়েছে।

আরও অনেক বিষয় আছে, যেখানে ড. ইউনূস সরকার অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, সবদিক থেকে বিধ্বস্ত দেশটিকে সঠিক ট্র্যাকে স্থাপন করতে পেরেছেন ড. ইউনূস, যা জনগণ স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করছে। আর থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাব না ফেললেও এর অন্যরকম গুরুত্ব আছে। এটি অন্যরকম প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে বালা-মুসিবত কেটে যাবে—এমন নয়। কারণ, ঘরে-বাইরের রাজনীতির অনেক খেলা আছে। থাকে চিরকালই। সঙ্গে আছে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের অহম, যা বিচূর্ণ হয়েছে ৫ আগস্ট। ফলে এক ধরনের আক্রোশের অনলে জ্বলছে আগ্রাসী দেশটি। এর বাইরে আরও অনেক খেলা আছে। এসব খেলায় প্রভাবিত হয়ে জনগণের স্বস্তি বিবেচনার বাইরে রেখে অন্য মতলবের কুশীলবরা এখন হয়তো বলবে শুরুতে উল্লেখ করা প্রচলিত গল্পের শেষ লাইনটি, ‘এত ভালো ভালো না!’

গ্রাম্য মতলববাজদের আদলে এই বাক্যের বিষয়ে সতকর্তার পাশাপাশি ঈদের প্রাক্কালে ৩০ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সতর্কবাণী বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, ‘ঈদের জামাতে দলমত নির্বিশেষ সবাই যেন পরাজিত শক্তির সব প্ররোচনা সত্ত্বেও সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকি, সেজন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করবেন, এই আহ্বান জানাচ্ছি।’ সাধারণভাবে মনে করা হয়, প্রধান উপদেষ্টার উল্লিখিত আহ্বান দেশবাসী অনুধাবন করতে পেরেছেন। ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে নানান আশঙ্কা কাটিয়ে উঠা গেছে। এই স্বস্তি ও তৃপ্তির পাশাপাশি এটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, নানান বিষয়ে বাংলাদেশের বিপদ কিন্তু পায়ে পায়ে চলমান। যার স্পষ্ট ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্তত দুই বছর আগে ১৯৪৫ সালে। অতএব, আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলেই কেবল নয়, সতর্ক থাকতে হবে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবস এবং জোৎস্নাস্নাত রাতেও। সজাগ থাকতে হবে অহর্নিশ!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রম্যলেখক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের রেলপথ ব্লকেড কর্মসূচি আজ

আল-আকসার ভাগাভাগি শুরু?

মাছ ধরতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পর্শে চাচা-ভাতিজার মৃত্যু

দুপুরের মধ্যে ঢাকায় ৬০ কিমি বেগে বজ্রবৃষ্টির আভাস

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মারা গেলেন ছোট ভাই

১৫ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বৈঠক আজ

পাবিপ্রবিতে জাতীয় ব্যবসা উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

ইসরায়েলি হামলা / আরও ৩৫ মৃত্যু, নতুন করে ঘরছাড়া ৫ লাখ মানুষ

১০

১৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

১১

১৭ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১২

চবির পাঁচ শিক্ষার্থীসহ ছয়জনকে অপহরণ

১৩

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট / হিন্দু বোর্ডে মুসলিম নেই, ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দু থাকবে কেন?

১৪

পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্যায়ে ইরান!

১৫

ক্লাসরুম ঠান্ডা রাখতে গোবরের প্রলেপ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে!

১৬

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে কে কার মুখোমুখি?

১৭

নব্য আওয়ামী লীগের রূপরেখা : ভারতের বার্তা ও নেতাদের পরিকল্পনা

১৮

সান সিরোতে মহাকাব্য, বায়ার্নকে টপকে সেমিতে ইন্টার

১৯

বার্নাব্যুর ম্যাজিকে কাজ হলো না, ঘরের মাঠে হেরে বিদায় রিয়ালের

২০
X