সব অনিশ্চয়তা ও আলোচনার অবসান ঘটিয়ে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে শুক্রবার বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন শেষে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হলো। গত বছর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের টানাপোড়েন। ফলে ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার আট মাস পেরিয়ে গেলেও দুদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সম্ভব হয়নি শুক্রবারের আগে। অর্থাৎ মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো বসলেন বৈঠকে। স্বভাবতই বৈঠকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটিকে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে কারও কারও মতে রয়েছে ভিন্নতাও।
আমরা জানি, গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে থমকে যায় দুদেশের সম্পর্কের গতি। এর পর থেকে যে টানাপোড়েন শুরু হয়, তা শুধু কূটনৈতিক পরিসরকেই ছাপিয়ে যায়নি; দুদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য। এমনকি উত্তেজনা সঞ্চারিত হয় দুদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে। উত্তেজনা ঘিরে জন্ম নেয় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সব মিলিয়ে এ বৈঠক সম্প্রতি চলে আসা সেই টানাপোড়েন থেকে উত্তরণের সুযোগ বলেও দেখছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য দুই দেশই অপর পক্ষের পছন্দ নয়—এমন দুয়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে বৈঠকে। আবার সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজ নিজ ভাষ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েই বৈঠক সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে ঢাকা ও দিল্লি—এটা একটা দিক। অন্যদিকে উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ার অঙ্গীকারও লক্ষণীয় তাদের বিবৃতিতে।
বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্য দেয়। আমাদের দুই দেশের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব পরস্পর সম্পর্কিত ইতিহাস, ভৌগোলিক নৈকট্য ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ে ভারতের সরকার ও জনগণের অটল সমর্থনের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’ অন্যদিকে সামাজিকমাধ্যম এক্সে মোদির বাংলায় লেখা পোস্টে উল্লেখ করা হয়, ‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি গঠনমূলক ও জনকেন্দ্রিক সম্পর্কের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ এ ছাড়া বৈঠকে তিনি বলেন, ‘ভারত সর্বদা একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সমর্থন করবে। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে জনগণের।’ বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণসহ তিস্তা, গঙ্গা চুক্তি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, সীমান্ত হত্যাবন্ধসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। এ বৈঠককে আন্তরিক, উৎপাদনশীল এবং গঠনমূলক বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। বৈঠকের আগে অবশ্য বৃহস্পতিবার বিমসটেক নেতাদের সম্মানে আয়োজিত নৈশভোজে ড. ইউনূসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির দেখা হয়। নৈশভোজে একই টেবিলে তারা পাশাপাশি বসেন। করেন কুশল বিনিময়। নরেন্দ্র মোদিকে ড. ইউনূস একটি ছবি উপহার দেন।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ নানাভাবে সংযুক্ত। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়েও প্রতিবেশী দুদেশ গভীর তাৎপর্য বহন করে। সুতরাং শুধু দুদেশের কল্যাণই নয়; একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নিজেদের ভবিষ্যৎ অবস্থান সুসংহত করতেও একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, এই বৈঠক শুধুই সৌজন্য বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই উভয় দেশকেই সর্বোচ্চ আন্তরিক হতে হবে।
মন্তব্য করুন