পুরান ঢাকার সব উৎসব-পার্বণ ছিল ধর্মীয় দিনগুলো কেন্দ্র করেই। এসব উৎসব পালিত হতো স্বকীয়তায়। এখনো কিছু কিছু অবশিষ্ট আছে। তবে বেশিরভাগই লুপ্তপ্রায়।
সেকালে রোজার মাসে পুরান ঢাকার চেহারা বদলে যেত। স্থানীয় ছোট-বড় সব হোটেলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত থাকত কাপড়ের পর্দা টানানো, এখনো সেই কায়দাটি রয়েছে। দুপুরের পরপরই সড়কের পাশে ইফতার বানানোর হিড়িক পড়ে যেত। বিক্রি হতো রকমারি ইফতার। চকবাজারের ইফতারি পূর্বের ধারাবাহিকতায় আজও টিকে আছে। তবে মানের ক্ষেত্রে ধস নেমেছে, সবই এখন নিম্নমানের। আকর্ষণীয় সেই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ হতে বিভিন্ন নামের আকর্ষণে এখনও দূরদূরান্ত থেকে অনেকে ইফতারি কিনতে আসে। বিক্রিও হয় দেদার। তবে আগের কারিগরও নেই, স্বাদ ও মান পড়ে গেছে।
পুরান ঢাকার ইফতার অতীতে যেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল আজও তেমনি। ফলমূল-মিষ্টি থেকে শুরু করে তেলেভাজা নানান পদের ইফতারের সঙ্গে মুড়ি-ভর্তা ছিল আবশ্যিক। পিঁয়াজু, ঘুঘনি, সুতি কাবাব, ফুলুরি, সরষে তেল মাখিয়ে মুড়ি মিশিয়ে বানানো মুড়ি-ভর্তা আজও অতীতের ইফতারের নিয়মিত মেন্যু হিসেবে স্থানীয়দের কাছে সমান জনপ্রিয়। মুড়ি-ভর্তা ছাড়া ইফতার এরা ভাবতেই পারে না। ইফতারের সময়ে এখনো সাইরেন বাজে। অতীতে প্রতি রাতে তিন দফায় পর্যায়ক্রমে মসজিদ থেকে সাইরেন বাজানো হতো, এখনো হয়। এ ছাড়া রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানোর জন্য কিছু লোক উর্দু ভাষায় সুর করে করে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকত সময় ধরে ধরে ‘ওঠো রোজাদারও সেহেরি খাও, রাত তিন বাজ গিয়া’। এরকম মানুষ এখনো আছে তবে সংখ্যায় কমেছে। ঈদের দিন ওরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং মসজিদের গেটে দাঁড়িয়ে বকশিশ আদায় করত; এখনো করে।
নতুন জামাই চানরাতে শ্বশুরবাড়ি এসে সালাম করে সালামি নিয়ে যেত। রোজায় জামাই-পক্ষ থেকে যেমন কনে-পক্ষ থেকেও তেমনি অঢেল ও রকমারি ইফতার বিনিময় হতো; এখনো হয়ে থাকে। নতুন জামাই বাড়িতে পাঠানো হতো ঈদ উপলক্ষে ঘি-মোরগ, পোলাওর চাল, সেমাই, চিনিসহ বিভিন্ন কাঁচা খাদ্য; সে প্রথা আজও আছে। আর্থিক অবস্থার হেরফেরে পরিমাণটা কম-বেশি হয়ে থাকে এই যা।
এলাকায় ও মহল্লায় রোজায় গানের দল তৈরি করত স্থানীয় যুবকরা। ‘কাসিদা’ নামে খ্যাত এই গানের দলগুলো রাতে এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে উর্দু গান কোরাস গেয়ে টাকা তুলত। আজকে এদের তেমন দেখা যায় না। ২৭ রোজার রাতে স্থানীয় মসজিদগুলোয় মুসল্লিদের ভিড় উপচে পড়ত। এ দিনের বিশেষ নামাজ আদায় শেষে শুকনো কাঁঠাল পাতায় তৈরি স্থানীয় ভাষায় ‘দাওনা’য় করে বিরিয়ানি বিতরণ করা হতো। মসজিদে-আসা মুসল্লিদের জন্য যেমন, একইভাবে প্রতিটি বাড়ির মহিলাদের জন্যও বিরিয়ানি পাঠানো হতো স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের মাধ্যমে।
চানরাত মানেই পুরান ঢাকার যুবকদের জন্য সংযম ও পবিত্রতার ইতি। এশার নামাজের পর রাস্তায় রাস্তায় স্থানীয় কিছু যুবকের মদ্যপানে মাতলামি-খিস্তিতে চানরাতের চেহারা হতো ভয়ংকর। রাতে তারা কেউ বাসায় ফিরত না, এদিক-সেদিক পড়ে থাকত। কাকভোরে বাসায় ফিরে নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের নামাজে অংশ নিত। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম করে সেলামি নেওয়ার হিড়িক পড়ে যেত। রাস্তার পাশের খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে খাওয়া, চকবাজারের ঈদের মেলা দেখতে যাওয়া এবং নানান ধরনের খেলনা-বাঁশি টুকিটাকি কিনে আনা ছিল কিশোর ও কৈশোর-উত্তীর্ণদের ঈদ পালন।
দুপুরের পর বুড়িগঙ্গার পাকা সিঁড়ি ঘাটগুলোয় বসে স্থানীয় যুবকরা তাস খেলত। অনেকে দল বেঁধে রূপমহল, আজাদ, নিশাত, তাজমহল, শাবিস্তান, লায়ন, স্টার, মুন, বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহের অভিমুখে ছুটত লাহোরে-নির্মিত ঈদে-মুক্তি পাওয়া উর্দু ছবি দেখতে। সাবিহা-সন্তোষ, মোহাম্মদ আলী-জেবা, ওয়াহিদ মুরাদ-রানী, এসব পাকিস্তানি তারকারা ছিল স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয়। ঈদের দিনেও মাতালদের মাতলামি যত্রতত্র দেখা যেত। রিকশা-ঘোড়া গাড়িতে করে দল বেঁধে দূরের আত্মীয় বাড়ি, হাইকোর্ট চত্বরে ঢাকার চিড়িয়াখানা দেখতে যাওয়া, এসব ছিল অপেক্ষাকৃত কমবয়সীদের বিনোদন।
ঈদের কেনাকাটার জন্য ছিল সদরঘাট আর নিউমার্কেট। বর্তমানের তুলনায় অনেক ছোট ছিল বায়তুল মোকাররম মার্কেট। মার্কেটের সিংহভাগ দোকানের মালিক ছিল অবাঙালি। দূরত্বের কারণে পুরান ঢাকার মানুষ সাধারণত বায়তুল মোকাররম মার্কেটে কেনাকাটা করতে যেত না। কেনা সেমাইর প্রচলন পুরান ঢাকায় খুব একটা ছিল না; হাতে-ঘুরানো কলে ঈদের আগে বাড়িতে বাড়িতে সেমাই তৈরি হতো। রোদে শুকিয়ে হালকা আঁচে ভেজে সেসব তুলে রাখা হতো ঈদের অপেক্ষায়। ঈদের দিন ঘি-চিনি, জর্দা রং দিয়ে রান্না করা হতো সেই সেমাই।
ঈদের দিন বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো বুড়িগঙ্গার পাড়ে ও পাকা ঘরের ছাদে। তখন একতলা বাড়িই ছিল বেশি। ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো তাই ছিল জুৎসই, যেটা আজ আর সম্ভব নয়। চারদিকে তিন-চার-পাঁচ-ছয় তলার ছড়াছড়িতে বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে। একতলার ছাদ বেশি থাকায় সবাই একতলার ছাদে ঘুড়ি ওড়াত, তাতে একটা সামঞ্জস্য থাকত। ওপর-নিচ ছিল না। ঘুড়ি ওড়াতে আর ধরতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
মনে পড়ে, পাকিস্তান টিভি চালু হওয়ার পর যাদের বাড়িতে টিভি ছিল, সন্ধ্যার পর সবাই সে বাড়িতে টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখতে ভিড় করত।
ঈদের সামাজিকতায় এখন অতীতের তুলনায় বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রকট হয়ে পড়েছে। আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ছিল অনিবার্য সামাজিকতা। এখন ওই সামাজিকতা আর নেই। মোবাইল ফোনে কিংবা খুদেবার্তায় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। মসজিদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ আদায়ের রীতি অনুসরণ করে বটে, তবে গায়ের পোশাক কারও হাজার হাজার টাকার কারও পুরোনো কিংবা অতি স্বল্প মূল্যের। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে এসে আহার করে। তবে সবার আহার ভিন্ন ভিন্ন, অর্থনৈতিক হের-ফেরে।
কোরবানির ঈদ মূলত বিত্তবানদের আনন্দ উৎসব। সাধারণ মানুষের জন্য তা কখনো আনন্দের ছিল না। আজও নেই। কোরবানির গরু কেনার ক্ষেত্রে আকার ও দামের একটা প্রতিযোগিতা ছিল, এখনো আছে। কে কত দামে কয়টি ও কত বড় গরু কিনেছে এ নিয়ে ছিল ঠান্ডা লড়াই। স্থানীয় আদি ঢাকাবাসী বিত্তবানরা অনেক গরু কোরবানি দিত। একটি গরু একা কোরবানি দেওয়ার মতো মধ্যবিত্ত মানুষের অভাব ছিল। আর স্থানীয়দের মধ্যে ভাগে কোরবানি দেওয়ার কোনো রেওয়াজ অতীতে ছিল না, আজও নেই। স্থানীয়রা গরুর পায়ের হাঁটু থেকে নিচের অংশ ফেলে দিত বুড়িগঙ্গা নদীতে। হাড় দিয়ে নেহারি খাওয়ার প্রচলন স্থানীয়দের মধ্যে তখন ছিল না। রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাট, গাবতলী, রমনা রেসকোর্স, হোসনী দালান সংলগ্ন মাঠে গরুর হাট বসত। মীর কাদিমের সাদা গাভীর কদর স্থানীয়দের কাছে পূর্বে যেমন ছিল, আজও তেমনি রয়েছে।
অতীতে একের অধিক নতুন জামা-কাপড় নেওয়ার সংস্কৃতি ছিল না। এখন তো জামা-কাপড়ের হিড়িক পড়ে যায়। কে কতটা এবং কত দামি জামা নিয়েছে এ নিয়ে ঠান্ডা প্রতিযোগিতাও লক্ষ করা যায়। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, অতীতে সামাজিক মেলামেশায় সবার জামা সবাই দেখতে পারত। আর এখন সামাজিকতা বিসর্জনের ফলে যার যার কাপড় পাল্টে পাল্টে পরে সত্য, তবে কাউকে দেখাতে পারে না। নিজেরটা নিজেই দেখে। বড় জোর পরিবারের সদস্যরাই দেখার সুযোগ পায়। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৈষম্য নিরসন ব্যতীত ঈদের সামাজিক উৎসব সামাজিকতা হারিয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার ভিড়ে সংকীর্ণ পরিসরে সীমিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য নিরসন না হলে ঈদের আবেদনও সর্বজনীন হবে না।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
মন্তব্য করুন