প্রাচীন কবিতাটি এমন: জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে? / মিছে জীব করো না ক্রন্দন ...
অমরত্ব শরীরে থাকে না। অমরত্ব শরীর দিয়ে অর্জনও অসম্ভব। অমরত্বের জায়গা মানুষের হৃদয়ে। সন্জীদা খাতুন সে অর্থে অমর। গত মঙ্গলবার তিনি তার নশ্বর দেহ ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন। গড়পড়তা বাঙালির আয়ু থেকে অনেক বেশিদিন বেঁচেছিলেন তিনি। আমরা সবাই জানি, একজন মানুষের চাইতে একটি কচ্ছপের আয়ু ঢের বেশি। একটি কাছিম পাঁচশ বছর বাঁচে। সে তুলনায় মানুষের আয়ু হাতেগোনা। তবু সন্জীদা খাতুন অনেক সময় ধরেছিলেন। ছিলেন বলতে সগৌরবে, স্বমহিমায় ছিলেন।
তার না থাকাটা কত বেদনার সেটা বলবে সময়। আমি যেটা বলতে চাইছি তা বলার আগে একটা ছোট ভূমিকা দিই।
তার কনিষ্ঠ ভগ্নি ফাহমিদা খাতুন। পাকিস্তান আমল থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে চিত্ত জয়ী শিল্পী। সুরে তালে গায়কীতে অসাধারণ। তাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করার সৌভাগ্য হয়েছিল। পরে একটি টিভির জন্য সাক্ষাৎকার বা আলাপচারিতারও সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি বলেছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দালালরা ফাহমিদা খাতুন ও তার বড় এই আপাকে খুঁজছিল। তাদের ভাষায়, মা কালীর গান গায় এরা। ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’—গাওয়া গাদ্দার টিপ পরা নারীদের খুঁজে পায়নি বলে সম্ভ্রমসহ জানে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা।
কী আশ্চর্য! সেই সোনার মন্দির শব্দের জন্য ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ কবিতাটি এখন পাঠ্যবই থেকে নাকি উধাও, তাও এই ‘সোনার বাংলা’ আমলে।
যার কথা লিখছি, তাকে সবাই চেনেন। বাংলা ও বাঙালির বাতিঘর তিনি। পতি ওয়াহিদুল হক ও অন্যদের নিয়ে যে মহীরুহ গড়ে তুলেছেন সেই ছায়ানট এখনো শিল্প সংস্কৃতির ছায়াবৃক্ষ। সমালোচনার অভাব নেই বঙ্গদেশে। বাঙালি এই কাজে নম্বর ওয়ান। তাদের অনেকে তার ব্যক্তিত্ব ও রুচির জন্য তাকে অনুদার মনে করেন। অথচ এই তথাকথিত উদার আর সুবিধাবাদের কারণেই এখন অপসংস্কৃতিও বাটপারদের রমরমা।
ছায়ানট আমাদের ছায়া। এর সুশীতল ছায়া তলে আমাদের দেশ ও জাতি পুষ্ট হয়েছে। আরও হবে। কিন্তু এই যে সন্জীদা আপার চলে যাওয়া এর একটা চিহ্ন তো পড়বে। সে চিহ্নটাই ভয়ের। কেন ভয়ের?
এখন সময় অন্য ধরনের। বাংলা ও বাঙালির জন্য সুখের সময় না। আমাদের যে হাজার বছরের ইতিহাস, আমাদের যে অসাম্প্রদায়িকতা, আমাদের যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল—তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। লালন ফকিরের মতো মরমি সাধকও আক্রান্ত। সত্যি বলতে গেলে যে পরিবর্তন সদার্থক হওয়ার কথা মানুষকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তা উধাও।
সন্জীদা খাতুন থাকলেই কি এসব আপদ বালাই দূর হয়ে যেত? তা হতো না। কিন্তু আশ্রয়ের যে জায়গা নির্ভরতার যে স্থান সেটি ছিল। বৈশাখ নিয়েও রাজনীতি চলছে। আগেও ছিল নোংরা রাজনীতি। কিন্তু তখন সন্জীদা আপার মতো অনেকেই ছিলেন, সরব ছিলেন। এখন মূক ও বধির তারা। কথা বলেন না। বলতে পারেন না। তাহলে কে ধরিবে হাল, কে তুলিবে পাল? প্রতি বছরের শুরুতে তার কণ্ঠে যে ঘোষণাপত্র তা শোনার আগ্রহ ছিল আমাদের। গানের চাইতে কম আকর্ষণ বহন করত না সে পাঠ। কারণ যিনি বলছেন সে মানুষটি রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতেন।
‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’—এই নামে তার যে গ্রন্থটি, তা শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীও পাঠ্য করে নিয়েছে। এমন করে রবীন্দ্রনাথকে কেউ চিনেছেন বলে মনে হয় না। যারা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে সেলিব্রিটি বা শীর্ষে তাদের অনেকের কাছে রবীন্দ্রসংগীত পণ্য। এর কাছে জীবন সুধা।
টিপ পরে অপমান মেনে নেওয়া এই সমাজ ও বদলে যাওয়া বাঙালির জননী স্বরূপা নারী তিনি। এখনো আছেন এখনো নিঃশ্বাস ও কথায় সমৃদ্ধ করেন। গত পহেলা বৈশাখে তার সকালবেলার ভাষণ শুনে মনে হয়েছিল, আকাশ পাড়ের ডাক শুনেছি...
নজরুলভক্ত বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্জীদা খাতুন গেলেন রবীন্দ্রসংগীতের দিকে। বাবার বন্ধু নজরুলের কোলে বসে গান শিখেছিলেন সন্জীদা খাতুনের বড় বোন যোবায়দা মির্যা।
নজরুলভক্ত বাবার মেয়ে কীভাবে রবীন্দ্রসংগীতের দিকে ঝুঁকলেন, সন্জীদা খাতুনের জবানিতেই সেই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ‘গুণীজন’ ওয়েবসাইটে তার জীবনীতে। সন্জীদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হলেন। ক্লাসে সৈয়দ আলী আহ্সান রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াতেন। সেই কবিতা পড়ে তার মন এমন হয়ে গেল যে, তিনি তখন রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে চাইলেন।
কিন্তু কোথায় শিখবেন? বাড়িতে শিক্ষক ছিলেন—সোহরাব হোসেন। তার কাছে সন্জীদা খাতুন অসংখ্য নজরুলগীতি, আধুনিক, পল্লীগীতি শিখেছেন। রবীন্দ্রসংগীত শিখতে তাই তিনি সেগুনবাগান থেকে প্রেস ক্লাবের মোড়ে এসে বাসে চড়ে আজিমপুরে হুসনা বানু খানমের কাছে যেতেন। তিনি যে স্বরলিপি থেকে গান শেখাতেন, তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখতেন সন্জীদা। খুব দ্রুত গান তুলে নিতে পারতেন। বাড়িতে ফিরেও গানগুলো গাইতেন। মাঝে মাঝে সুর ভুলে যেতেন, কিন্তু কীভাবে কে জানে, মাঝরাতে সুরগুলো আবার ফিরে আসত।
এই যে অলৌকিক যোগাযোগ—এর একটা ব্যাখ্যা পাই শঙ্খ ঘোষের বয়ানে। তার ভাষায়, ‘সন্জীদার আবির্ভাব মানেই স্বতঃস্ফূর্ত গানের আবির্ভাব। এখানেই তার গানের আর তার ব্যক্তিত্বের বিশিষ্টতা: এই স্বতঃস্ফূর্ততায়, এই সাবলীলতা, এই স্বচ্ছতায়।’ ‘গানই তার জীবন’ শিরোনামের স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন, ‘(ব্যক্তি) সন্জীদা খাতুন আরেকরকম মানুষ। গান গাইতেই তার আনন্দ, গান শোনানোতেই তার আনন্দ। কেননা গান তার কাছে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, গান তার জীবিকা নয়, গান তার জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া জীবন। ‘ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে দেশে আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে, আর আজ জানি যে সে গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়। খুব কম সংগীতশিল্পীই তা পারেন।’
এরপর আর কথা থাকে না। আমরা এখন সবাই মিলে যে সংকটকাল অতিক্রম করছি তাতে তার মতো মানুষের সাহচর্য বা উপদেশ ছিল অনিবার্য। কায়াহীন সন্জীদা খাতুন আর তা করতে পারবেন না। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের নাম ছায়ানট তার সুদীর্ঘ ছায়া সন্জীদা খাতুন। সে ছায়া কি আমাদের ঘিরে রাখবে না? আজ রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষা, বাংলাদেশ; এমনকি বাঙালির ঘোর দুর্দিন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরূপ কালো ছায়া। এমন কঠিন সময়ে তিনি আছেন জানলেও শান্তি ছিল। সে শান্তি থেকে বহুদূরে চলে যাওয়া আরেক শান্তি পারাবারে তাকে আশ্রয় দেবেন বিশ্বপিতা।
চলে যাওয়ার কদিন আগেও বলেছেন, তার মনে গান আসছে বারবার। গানের মানুষ প্রাণের মানুষ, টিপের মানুষ, বজ্রকঠিন ব্যক্তিতে সুধাময়ী মানুষ সন্জীদা খাতন। তার চলে যাওয়া সাধারণ কোনো প্রস্থান নয়। এর নাম মুক্তি। সমাজ ও জাতির আবদ্ধতা থেকে মুক্ত মুক্তির দূত সন্জীদা খাতুন আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সিডনিপ্রবাসী ছড়াকার ও প্রবন্ধকার
মন্তব্য করুন