সোমবার, ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩২
আলম রায়হান
প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৫, ১০:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর প্রয়োজন

শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর প্রয়োজন

বাংলাদেশে একটি প্রধান প্রবণতা হচ্ছে, শিক্ষার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ। বিত্তহীন থেকে উচ্চবিত্ত, সবাই সন্তানকে লেখাপড়া করাতে চান। কিন্তু প্রচলিত ধারায় এ আকাঙ্ক্ষার ফলাফল কী? গত বছর ১৩ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রধান সংবাদের শিরোনাম, ‘দেশে কোটির বেশি বেকার!’ পরীক্ষায় পাসের সার্টিফিকেটধারী বেকারদের নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের আলোকে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। যাদের প্রসঙ্গে রিপোর্ট করা হয়েছে তাদের অনেকেই প্রয়োজনীয় পর্যায়ে লেখাপড়া না জানলেও কাগজপত্র অনুসারে তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং স্বাক্ষরের স্থলে লিখতে হয় না ‘নিংবং’। অর্থাৎ, ‘ব-কলমের পক্ষে নিশান সই’। এই হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের খানিক চিত্র। আর কিঞ্চিৎ পরিষ্কার করে বললে বলতেই হবে, দেশের শিক্ষা মোটের ওপর সর্বনাশের কফিনে শায়িত। এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার মতো লোকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। নেই বললেই চলে। তবে কীভাবে এই সর্বনাশ হলো? এই প্রশ্ন করার লোক অগুনতি, এবং এ ব্যাপারে উদ্বেগ আকাশ প্রমাণ। এ ক্ষেত্রে হিমালয়ও ছোট।

এদিকে প্রমাণিত প্রবচন, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কাঠামো এবং নানান ধরনের অনাচারী ধারী ধারা কি জাতির মেরুদণ্ড তৈরি করে নাকি অভিজাত বেকার শ্রেণি এবং বিভিন্ন কাণ্ডের দণ্ড, মানে লাঠি বানায়? এটি কিন্তু বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের মহিমান্বিত করা হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কারণে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া থেকে শুরু করে মুজিব-জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকা মহিমান্বিত করার ধারা চলমান। সর্বশেষ রাজনীতিতে হায়নাসম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিদায়ে তো ছাত্ররাই যেন সব! এমনকি সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস তাদেরই নিয়োগকর্তা হিসেবে প্রকাশ্যে আখ্যায়িত করেছেন। আর সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টিকে তো বলাই হয়, ছাত্রদের রাজনৈতিক দল। শুধু তাই নয়, দেশে ভালো-মন্দ এমন কোনো কাজ নেই, যা ছাত্ররা করে না। কিন্তু ছাত্রদের যেটি মূল কাজ, সেই লেখাপড়ার খবর কী? এক কথায় বলা হয়, নিদারুণ! আর এ জন্য দায়ী কেবল ছাত্রদের অতি রাজনৈতিক কর্ম এবং কতিপয়ের অপকর্ম নয়। পেছনে অনেক খেলা আছে, আছেন অনেক ভ্রান্তি। বেশিরভাগ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। সরকার বিনামূল্যে বই দেয়, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়; কিন্তু সেখানে নিয়োগবাণিজ্য চলে। ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া যায় না। কারও কারও মতে, শিক্ষার দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্র ক্রমাগত পিছু হটছে।

এদিকে অনেকেই মনে করেন, শিক্ষায় বিরাজমান দশার জন্য অনেকটাই দায়ী সরকারি নিয়মকানুন ও গোঁজামিলের ব্যবস্থাপনা, প্রকাশ্য দুর্নীতি, মসনদে টিকে থাকা ও ক্ষমতা দখলের জন্য শিক্ষার্থীদের অপব্যবহার করা। মসনদ প্রশ্নে ছাত্রদের ব্যবহার করেছে সবাই। অবশ্য জেনারেল এরশাদ একপর্যায়ে তার দলের ছাত্র সংগঠন বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও এ ঘোষণাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা হয়। মানতেই হবে, ছাত্রদের অতিমাত্রায় রাজনীতিতে ব্যবহারের কারণে শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বেজেছে। শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশের আর একটি অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে, শিক্ষক রাজনীতি এবং শিক্ষা প্রশাসনে শিক্ষকদের গণহারে নিয়োগ প্রদান। বিবেচনায় রাখা ভালো, কোনো ঘটনা একটি মাত্র কারণে ঘটে না। তবে শিক্ষার যে নাকাল দশা তার বীজ লুকায়িত সরকারের বিধিবিধান ও অনুশীলনের মধ্যে। একেই বলে, সরিষার মধ্যে ভূত! এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর উচ্চতর ডিগ্রিধারী এক লাখের বেশি বেকার চাকরি খুঁজেছে। তারা দেশে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি উচ্চ ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের দক্ষতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা স্নাতকসহ বেকারদের সংখ্যা ছিল ৯ লাখ ৬ হাজার। এক বছর আগে ছিল ৭ লাখ ৯৯ হাজার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুসারে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার এক বছর আগে ১২ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে বেড়ে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। এসব চিত্র উঠে আসছে পরিসংখ্যানে।

অবশ্য পরিসংখ্যান প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ কেউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাণীসম কথাকে উদ্ধৃতি করতে পারেন, ‘মিথ্যা হচ্ছে তিন প্রকার। লাই, ড্যাম লাই, স্ট্যাটিসটিকস!’ সুনীলের এ বচন চেতনায় ধারণ করলে ১৭ কোটি মানুষের দেশে কোটি শিক্ষিত বেকারের স্ট্যাটিসটিকস তথা পরিসংখ্যান নাহয় বিবেচনায় নাই নেওয়া হলো! যেমন ড. ইউনূস সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা বিশ্লেষণের সময় অনেকেই আগের ভয়াবহ পরিস্থিতিকে তেমন বিবেচনায় নেন না। একই প্রবণতায় নিমজ্জিত হয়ে শিক্ষার বিষয়ে পরিসংখ্যান বিবেচনায় নাইবা নেওয়া হলো! কিন্তু শিক্ষিত বেকার প্রসঙ্গে সদ্য সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের উচ্চারণ কী বিবেচনায় না নিয়ে উপায় আছে? এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, তাকে কোনো অবস্থায়ই অতীতের বাচাল প্রবণতার শিক্ষামন্ত্রীদের সমান্তরালে দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ২২ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে! এর পেছনে রয়েছে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন। পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগে প্রচণ্ড অনিয়মও দায়ী।’ কিন্তু মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা যা বলেননি বা বলতে তার মনে ছিল না অথবা এড়িয়ে গেছেন তা হচ্ছে, শিক্ষার সর্বনাশের জন্য প্রধানত দায়ী এ খাতে নানান অব্যবস্থাপনা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবাধ বাণিজ্য এবং নিয়ন্ত্রণহীনতা। যেসব কারণে নেতিবাচক আলোচনার শীর্ষে রয়েছে পুলিশ, সে বিষয়গুলো শিক্ষা খাতে অনেক আগেই জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে আছে এবং উচ্চ মাত্রায় বিরাজমান। কিন্তু এটি মুখে এনে সাধারণত কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। একসময় ভাশুরের নাম মুখে আনা হতো না। হয়তো একই কারণে সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টাও ঝুঁকি নিতে চাননি। অথবা সেই প্রবচন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, ‘ওপরে থুথু ফেললে নিজের মুখে পড়ে।’ কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় কেউ তো তার ওপরে ছিলেন না; বরং নিচে। তাহলে মূল বিষয়ে তিনি কেন আলোকপাত করেননি? সরকারের নড়বড়ে ভিত আরও নড়বড়ে হওয়ার আশঙ্কায়? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না, যা পাওয়ার নয় সে চেষ্টা না করাই শ্রেয়। এ বিষয়ে তো প্রকারান্তরে রবিঠাকুরের গানেও ধারণা দেওয়া আছে, ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর...।’

শিক্ষার সর্বনাশে মূল বিষয় কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যাক। শিক্ষার সর্বনাশ যে ক্যান্সারের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে, তা কিন্তু রাখঢাকের পর্যায় অতিক্রম করেছে বহু আগেই। ১৯৪৭ ও ৭০-এর পর ব্যাপক হারে উপযুক্ত শিক্ষক সংকট তৈরি হওয়ার পর শিক্ষা খাতের দুরবস্থা স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রমাগত অধগতির ধারায় মহামারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে কোচিং আকারে। বহু বছর আগে কোচিং ব্যবস্থা আদম ব্যবসার মাত্রা ছাড়িয়ে গণশৌচাগারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। আর এটি কেবল কতিপয় উদ্যোক্তার ব্যবসার প্রয়াস এবং কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের কিছু আয়-রোজগারের পর্যায়ে নেই, যা একসময় টিউশনি হিসেবে পরিচিত ছিল, তা বিরল পান্ডার মতো এখন ধুঁকছে। টিউশনির খাত দ্রুত কোচিং-বাণিজ্য চক্রের দখলে চলে গেছে। এবং বেশ কয়েক বছর ধরেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী মানেই কোচিং সেন্টারের ছাত্রছাত্রী। এদের এখন আর স্কুল-কলেজে যেতে হয় না। কেবল খাতায় নাম থাকলেই চলে। এবং স্কুলের খাতায় নাম থাকলে অবশ্যই স্কুল কোচিংয়ের খাতায় নাম থাকতেই হবে। স্কুলের কোচিং খাতায় নাম না থাকলে বিভিন্ন রকমের হেনস্তা অনিবার্য। এই ধারায় এক একটি স্কুল পরিণত হয়েছে এক একটি কোচিং বাণিজ্যকেন্দ্রে। এখানেও পড়ানো হয় না, কেবল মাস শেষে নির্ধারিত টাকাটা দিলেই চলে। গবেষণায় দেখা গেছে, চতুর্থ শ্রেণি থেকেই কোচিং-বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। তবে এটি মনে করার কোনোই কারণ নেই, বিদ্যালয়ে কেবল কোচিং-বাণিজ্য চলে। আরও বহু বাণিজ্য মহামারিতে পরিণত হয়েছে। এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তলানিতে নেমে গেছে। আর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষা গ্রহণ এবং অনেক বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা শিক্ষাবোর্ডগুলোর অবস্থা কেবল কয়েক ধাপ নিচে নয়, একেবারে তলানিতে!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রম্যলেখক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজীপুরে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ভারতে ঈদগাহে আসা মুসলিমদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাল হিন্দুরা

ঈদগাহে মুসল্লিদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা

‘দ্রুত নির্বাচন না হলে আরও একটি স্বৈরাচার জন্ম নিতে পারে’

‘১৭ বছর পর স্বাধীনভাবে ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছি’

সাম্যের প্রতীকে উদযাপিত হচ্ছে ঈদুল ফিতর

মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টা গ্যাসের স্বল্পচাপ থাকবে যেসব এলাকায়

এবারের ঈদে অনেক পার্থক্য আছে: মির্জা ফখরুল

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা বিএনপির

শোলাকিয়ায় ৬ লক্ষাধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে ঈদ জামাত

১০

সব ধরনের নেতিবাচক কাজ থেকে দূরে থাকার আহ্বান সারজিসের

১১

ঈদের ময়দানে ব্যতিক্রমী আপ্যায়ন

১২

সিলেট শাহী ঈদগাহে লক্ষাধিক মানুষের নামাজ আদায়

১৩

বায়তুল মোকাররমে ঈদের পাঁচ জামাত অনুষ্ঠিত

১৪

ঈদ উপলক্ষে বিশেষ বার্তা দিলেন হামজা ও জামাল

১৫

শ্রীমঙ্গলে রাতভর বিএনপির দু’গ্রুপের সংঘর্ষ, সাবেক মেয়রসহ আটক ১৪

১৬

৮ বছর পর নুজাইরা বাবার সঙ্গে ঈদ করবে

১৭

ঈদের দিন সুস্থ থাকতে কী কী খাবেন

১৮

সারা দেশে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদুল ফিতর উদযাপন

১৯

ঈদের দিন বদহজম থেকে রক্ষা পাবেন যেভাবে

২০
X