গোপালভাঁড় সেদিন যে কি এক সর্বনাশা সংবাদ পরিবেশন করিল! ইহার পর হইতে সর্বত্র এক চাপা উত্তেজনা। রাজদরবারের উপস্থিত সভাসদগণের অধিকাংশই যেন বাকশক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। মন্ত্রীমহাশয় অস্থির হইয়া রাত পোহাইবার প্রায় সঙ্গেই রাজদরবারের আশেপাশে পায়চারি করিতেছে। অপেক্ষা শুধু প্রহরীরা কখন রাজদরবারের সিংহদ্বার খুলিয়া দিবে। রাজজ্যোতিষী তাহার বাড়ির ছাদে বসিয়া নির্নিমেষে আকাশের দিকে চাহিয়া গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব করিতেছে, মাঝেমধ্যে শূন্যে আঙুল দিয়া দেখার চেষ্টা করিতেছে। রাজপণ্ডিত পরামর্শ করার জন্য মন্ত্রীর বাড়ির দরজার সামনে হাঁটাহাঁটি করিতেছে। আর সেনাপতি এমন করিয়া দাঁত কিড়মিড় করিতেছে, যেন কল্পিত অদৃশ্য প্রতিপক্ষের মুখমণ্ডল ঘুসিতে ঘুসিতে রক্তাক্ত করিয়া দিবে।
ওদিকে বিজ্ঞানী তাহার ছোট গবেষণাগারে নিমগ্ন হইয়া নানারকমের রাসায়নিক পদার্থ লইয়া এমন কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করিতেছেন, যাহা সম্ভবত কৃষ্ণনগরকে সম্ভাব্য বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় হইতে রক্ষা করিবে। রাজবদ্যি নানা ধরনের পাঁচন আর শিকড়-বাকড় লইয়া অতিমাত্রায় ব্যস্ত—এই সব ওষুধ পথ্য যদি রাজদরবারের কাহারও কোনো প্রয়োজন পড়ে সেই জন্য।
অবশ্য হাটে-বাজারে যে যার মতো বাজারঘাট করিতেছে, ভোলা ময়রার দোকানে একটা অন্যরকম ব্যস্ততা—গতরাতে মন্ত্রীমশাইয়ের নির্দেশ লইয়া কটা ঘটা আসিয়াছিল। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ভোলা ময়রাকে তিন মণ জিলাপি, তিন মণ করিয়া রাজভোগ, পাতুয়া, সন্দেশ এবং প্রচুর পরিমাণে লুচি বানাইয়া রাখিতে হইবে। নতুন মহারাজ হিসেবে গবুচন্দ্র যেই মুহূর্তে সিংহাসনে উপবেশন করিবেন সেই মুহূর্তেই অর্ধেক আহার্য বস্তু মন্ত্রীর কাছে পাঠাইতে হইবে এবং বাকি অর্ধেক রাজদরবারের মন্ত্রীর অনুগত সভাসদদের নিকট পৌঁছাইতে হইবে। ইহার পর কৃষ্ণনগরের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করিবেন নতুন মহারাজ।
গোপাল, বিজ্ঞানী, রাজকবি, সেনাপতি এমন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের ভাগ্যে কী ঘটিবে, ইহা লইয়া মুর্শিদাবাদ কিংবা দিল্লির মনোভাব ঠিকমতো অনুমান করা যাইতেছে না, তবে কটা ঘটা শঠ কুলশিরোমণি ভগবান চন্দ্রদের যে দারুণ উন্নতির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছে ইহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
সময় বহিয়া যাইতে থাকিল। রাজদরবারের প্রধান ফটক তখনও বন্ধ। একে একে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সভাসদগণ সিংদ্বারের সম্মুখে সমবেত হইতেছে। কিন্তু রুদ্ধদ্বার খুলিবার কোনো লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। মন্ত্রী দরজায় একাধিকবার করাঘাত করিলেন, কিন্তু সেই শব্দ রাজভবনের অভ্যন্তরে কেহ যে শ্রবণ করিতে পারিতেছে, তেমন কিছুও মনে হইল না। মন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সিংহদ্বারে কয়েকবার পদাঘাতও করিলেন। কিন্তু উহাতেও কোনো অন্যথা হইল না। অধৈর্য মন্ত্রী এবার সক্রোধে চিৎকার করিয়া বলিলেন,
: কই, কে আছে ভিতরে? প্রহরী এ্যাই প্রহরী দরবারসভা শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেল তবু ব্যাটারা কোনো রকম সাড়াশব্দই করছে না কেন? সিংহাসনে বসার পর ওদের সবাইকে একে একে শূলে চড়াবো। তখন বুঝবে মজা! আমি কৃষ্ণনগরের নতুন রাজা আর আমার সঙ্গেই কি না এই বেয়াদবি! রাজজ্যোতিষী গলা খাঁকারি দিয়া বলিল,
—মন্ত্রীমশাই—ও মন্ত্রীমশাই!
মন্ত্রী— কে মন্ত্রীমশাই! খবরদার আমাকে এখন থেকে মহারাজ বলে সম্বোধন করবে। কেউ যদি আমাকে এরপর আবার মন্ত্রীমশাই বলে ডাকে তাহলে তাকে অবশ্যই শূলে চড়ানো হবে।
রাজজ্যোতিষী— এখুনি আমি গণনা করে দেখলাম, হঠাৎ করে একটু আগে রাহু এসে ঢুকে পড়েছে বুধের সামনে। এতে নতুন সংকট সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই একটু অপেক্ষা করে রাহুর দশা কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। আমি বরং পুরুত ঠাকুরকে তাড়াতাড়ি ডেকে এনে একটা যজ্ঞের ব্যবস্থা করতে হবে।
মন্ত্রী— বলো কি! এতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। আমরা কি ততক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?
কটা— যদি অভয় দেন তো আমি একটা পরামর্শ দিই মন্ত্রীমশাই!
মন্ত্রী— এ্যাই, এ্যাই কটা— কী বলে ডাকলি আমাকে?
কটা— কী আবার, মন্ত্রীমশাই বললাম!
মন্ত্রী— ওরে মর্কট, এখন কি আর আমি মন্ত্রী আছি? আমি তো এখন থেকে রাজামশাই! কৃষ্ণনগরের মহারাজা— মহারাজ গবুচন্দ্র।
ঘটা— তা তো ঠিকই আছে। কিন্তু যতক্ষণ সিংহাসনে আপনি না বসছেন, যতক্ষণ ধান দুব্বো দিয়ে মন্ত্রপাঠ না করে আপনাকে সবাই বরণ না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তো...
মন্ত্রী— চোপ! একদম চোপ! ব্যাটা বাটপাড়, আমাকে আবার নিয়ম শেখাতে এসেছে।
কটা— মন্ত্রীমশাই, ঘটা তো ঠিকই বলেছে! আপনি তাকে বাটপাড় বল্লেন কেন? ও যদি বাটপাড় হয় তাহলে আপনি...
মন্ত্রী— আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝেছি আর বলব না, হলো তো! তোদের ওপর কি আমি রাগ করতে পারি! এখন বল, এভাবে মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা আর কী করতে পারি। কীভাবে ভেতরে ঢুকব, কীভাবে সিংহাসনে বসে রাজত্ব করব, কীভাবে প্রজাদের খাজনা বাড়াব, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
রাজজ্যোতিষী এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকাইয়া ছিল। এখন সে বলিল—
—তিনটি উপায় আছে মন্ত্রীমশাই। প্রথম উপায় হলো, আপনার উচিত সোজা মুর্শিদাবাদে গিয়ে নবাব বাহাদুরের কাছে পুরো ব্যাপারটা জানানো; দ্বিতীয় উপায় হলো, যেভাবেই হোক গোপালকে খুঁজে বের করে তার একটা পরামর্শ নেওয়া আর তৃতীয় উপায় হলো, একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে সমস্ত পরিস্থিতি জনগণের কাছে তুলে ধরা।
মন্ত্রী— আরে আরে রাজজ্যোতিষী মহাশয়, এ কি বলছ তুমি! তুমি তো থাকো গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে, তুমি আবার গোপালের মতো এরকম বুদ্ধি পরামর্শ শিখলে কী করে?
কটা-ঘটা— পরিস্থিতি মন্ত্রীমশাই, পরিস্থিতি।
মন্ত্রী— বুঝলাম। আচ্ছা, এখন আর এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁহাতক অপেক্ষা করা যায়! বরং দুটো দিন চিন্তাভাবনা করা উচিত। চল, কটা-ঘটা, তোরা একটু বুদ্ধি বের কর, এখন কী করা যায়! সিংহাসন খালি অথচ আমি সেই সিংহাসনে বসতেই পারছি না। এই কষ্ট কি মেনে নেওয়া যায়! বুঝতে পারছি একটা চালাকি হয়েছে! আমি কৃষ্ণনগরের রাজত্বটা একবার পাই, তখন দেখব, কত ধানে কত চাল!
লেখক : প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা
মন্তব্য করুন