এম মঞ্জুরুল করিম রনি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর গাজীপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বাবা অধ্যাপক এম এ মান্নান গাজীপুরের মেয়র ও বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাবা-ছেলে দুজনই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নানাভাবে মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। এম মঞ্জুরুল করিম রনি আগামী দিনে তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রাখছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মোতাসিম বিল্লাহ
কালবেলা: গত ১৬ বছরে আপনার পরিবার নিষ্ঠুর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার কাছে বিস্তারিত জানতে চাই?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: ২০১৩ সালে আমার বাবা মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমার পরিবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। আমার বাবার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহ খান। নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান অর্থাৎ আমার বাবা। এরপর থেকেই শুরু হয় মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও নির্যাতন। একই সঙ্গে সারা দেশে বিএনপি থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপরও মিথ্যা মামলা ও নির্যাতন শুরু হয়। শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বন্দি করে রাখা হয়। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়। ২০১৪ সালে হয় জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ছিল তাদের জন্য একটি বড় ধাক্কা। এই পরাজয় তারা মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে বাবার ওপর তাদের ক্ষোভ ছিল এবং ২০১৪ সাল থেকে আমার বাবা এবং আমার পরিবারের ওপর তাদের ক্র্যাকডাউন শুরু হয়।
কালবেলা: গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আপনার বাবা অধ্যাপক এম এ মান্নানকে প্রথম কবে এবং কীভাবে গ্রেপ্তার করা হয়?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথমে আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর কিছু পূর্ব থেকেই আমরা আঁচ করতে পারছিলাম যে, আওয়ামী লীগ সরকার একটি ক্র্যাকডাউন চালাবে। আমার বাবাকে যখন একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। মামলাটি ছিল একটি বাস পোড়ানো সংক্রান্ত। বাবাকে গ্রেপ্তার করে গাজীপুর এসপি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় গাজীপুরের এসপি ছিল হারুন, যিনি ডিবি হারুন নামে বেশি পরিচিত। এসপি অফিসে আমার বাবা বারবার প্রশ্ন করছিলেন তাকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো এবং ওয়ারেন্ট কোথায়? তারা কোনো ওয়ারেন্ট দেখাতে পারেনি তবুও আমার বাবার ওপর জোর প্রয়োগ করছিল জেল-গারদে ঢোকার জন্য। ঘটনার অনেক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুঁজলে পাওয়া যাবে। জামিন হওয়ার পরও বাবাকে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হতে থাকে। এভাবে তাকে ৩৪টি মামলায় ফাঁসানো হয়।
কালবেলা: আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল হয়ে যায় এবং অনেক প্রতিষ্ঠান ভেঙে চুরমার করে মালপত্র লুট করে নিয়ে যায়। সে বিষয়ে জানতে চাই।
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: ঢাকা বিমানবন্দরে বাংলাদেশের প্রথম এয়ারক্রাফট মেনটেইন্যান্স অর্গানাইজেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলাম। এক রাতের মধ্যেই আমার প্রতিষ্ঠানটি দখল হয়ে যায়। আজও দখলদাররা সেই ব্যবসাটি পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের পতনের পর আমি সিভিল এভিয়েশনে আবেদন করেছি আমার ব্যবসাটি ফিরে পাওয়ার এবং ন্যায্য বিচারের। সেটা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তবে অবশ্যই আমি আশাবাদী।
কালবেলা: আপনার বাবা গাজীপুরের প্রথম মেয়র এবং সাবেক মন্ত্রী ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার ওপর কী ধরনের নির্যাতন চালানো হয় সে বিষয়ে জানতে চাই?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: আমার বাবা আওয়ামী লীগ সরকারের মিথ্যা মামলায় প্রায় আড়াই বছর কারাভোগ করেছেন। কারাবন্দি থাকাকালীন মানসিক নির্যাতন তো ছিলই। বাবা-মা দুজনে সে সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। জেলের মধ্যেই বাবার দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়। সেই হার্ট অ্যাটাকের সুচিকিৎসাও আমরা করাতে পারিনি। এগুলো ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত। আমার বাবাসহ এরকম বিরোধী নেতা যাদের বয়স হয়েছে তাদের জেলে রেখে তিলে তিলে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। তারা জানত জেলে থাকলে তারা নানাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং তাদের ভালো চিকিৎসা দেওয়া হবে না। একপর্যায়ে তারা মৃত্যুর দিকে চলে যাবে। খুব পরিকল্পিতভাবেই এগুলো করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
কালবেলা: আপনি অভিযোগ করেছিলেন আপনার পরিবারের কাছে টাকা-পয়সা চেয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: বাবা যখন জেলে বন্দি ছিলেন তখন টাকা-পয়সা দেওয়ার জন্য আমার পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল। বিশেষ করে তারা আমার মাকে এসপি হারুনের লোকজন বারবার কল দিত। তারা বলত যদি আপনার হাসবেন্ডকে বের করতে চান, তাহলে এত টাকা দিতে হবে। আমার মা আমাকে বলতেন টাকা-পয়সা দিয়ে হোক বা যেভাবে হোক বাবাকে কারাগার থেকে বের করতে। কারণ এরই মধ্যে বন্দি অবস্থায় তার দুটি হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাবা লোক মারফত আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কারাগারে তিনি মারা যাবেন তবুও যেন আমি তাকে বের করার জন্য এক টাকাও লেনদেন না করি।
কালবেলা: আপনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কয়টি মামলা হয়েছে এবং সেগুলো কী অবস্থায় রয়েছে? আপনার ওপর কোনো নির্যাতন করা হয়েছে কি না?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: আমার বিরুদ্ধে প্রায় ১৪টি মামলা হয়েছে, যেগুলো এখনো চলমান। আমি এখনো জামিনে রয়েছি। বাবা যখন পুরোপুরি অসুস্থ তখন ২০১৮ সালে আমি দেশে প্রবেশ করি। বাবা তখন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। কাউকে সহজে চিনতে পারতেন না। এমনকি আমাকেও চিনতে তার কষ্ট হয়েছে। আমি বাবার সঙ্গে যতটা সম্ভব সময় কাটানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে বাসায় রাত কাটতে পারতাম না। অনেক সময় গাড়িতে কাটিয়েছি, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজনের বাসায় থাকতে হয়েছে। কখনো কখনো বন্ধুর অফিসের ফ্লোরে ঘুমাতে হয়েছে রাতের পর রাত।
কালবেলা: যে স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলেন সে স্বপ্ন পূরণ হবে বলে মনে করছেন কি?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: যেহেতু গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন ঘটেছে এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে সুতরাং আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। আমরা আশা করছি বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশ গড়ার জন্য ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন। সেই ৩১ দফা আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছি। এই ৩১ দফা যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে আশা করি একটি সুন্দর বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে পারব।
কালবেলা: গাজীপুর-২ আসনের মাটি ও মানুষের প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু কাজ করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে?
এম মঞ্জুরুল করিম রনি: রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে ছোটবেলা থেকেই এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার একটি সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। বাসায় প্রচুর রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ আসা-যাওয়া করত। তাদের সঙ্গে একটু বন্ডিং ছোটবেলা থেকেই ছিল আমার। আমি যখন মনে করতাম কিছু না কিছু আমাকে করতে হবে, তখন রাজনীতিকে বেছে নিয়েছি। আমি মনে করেছি, ভালো কিছু করতে হলে রাজনীতির থেকে বড় কিছু নেই।
আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আমার বাবার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন, যারা অত্যন্ত প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, তারাও আমাকে ভালোবাসা দিয়ে গাইড করছেন। এলাকার মানুষও আমাকে সেভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। আমিও সবসময় চেষ্টা করেছি তাদের প্রত্যাশা পূরণের। এতদিন শুধু ভালোবাসা ছাড়া তাদের দেওয়ার মতো কিছুই আমার ছিল না। আমার বাবা যখন ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া তাকে মন্ত্রী করে গাজীপুরের মানুষকে সম্মানিত করেছিলেন। বাবা তখন এলাকার জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। আমিও বাবার মতো এলাকার মানুষের সেবা করে যেতে চাই। গাজীপুরের জনমানুষকে নিয়েই হবে আমার রাজনীতি।
শ্রুতি লিখন: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন