ফিলিস্তিনের গাজায় যে যুদ্ধবিরতি ছিল, সেটি ইসরায়েল অত্যন্ত বিধ্বংসী উপায়ে ভঙ্গ করেছে। মূলত এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ ছিল শুধুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য একটি রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার অংশ। দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প এটিই চেয়েছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে। তিনি তা গ্রহণও করেছিলেন।
বাস্তবিক অর্থে জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির সঙ্গে গাজায় গণহত্যা বন্ধের কোনোই সম্পর্ক ছিল না। এমনকি হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলিদের দেশে ফিরিয়ে আনারও কোনো সম্পর্ক ছিল না। এসব বিষয়ে নেতানিয়াহু কখনোই আন্তরিক ছিলেন না। এখনো আন্তরিক নন। এ মুহূর্তে যেমন বেশিরভাগ ইসরায়েলি অধিবাসীই জানেন যে নেতানিয়াহুর একমাত্র উদ্বেগ কেবলই তার নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
অক্টোবরের (৭ অক্টোবর, ২০২৩) হামলার একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য নেতানিয়াহুর ওপর প্রচণ্ড অভ্যন্তরীণ চাপ ছিল। এখনো সে চাপ রয়েছে। দিন দিন তা বাড়ছে। তদন্তটি হলে তার দোষ প্রমাণিত হতো। সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এরই মধ্যে তাদের দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন। নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা গাজায় হামাসের কাছে বিদেশি অর্থ পাচারের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আবার রয়েছে ঘুষের অভিযোগও। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ‘শিন বেট অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিষেবা’-এর প্রধান নাদাভ আরগামান জনসমক্ষে নেতানিয়াহুর দিকে আঙুল তুলেছিলেন। তিনি তখন হুমকি দিয়েছিলেন নেতানিয়াহুর সবচেয়ে অন্ধকার জগৎ বা গোপন তথ্য প্রকাশ করার।
চলতি বছর জানুয়ারিতে তিন ধাপে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। সে চুক্তির কারণে কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিপরিষদের আরেক চরমপন্থি অংশীদার বেজালেল স্মোট্রিচ হুমকি দেন যে, যদি ইসরায়েল যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায় এবং গাজা থেকে সব ইসরায়েলি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ গ্রহণ করে, তবে তারাও একইভাবে পদত্যাগ করবেন। এদিকে জীবিত একজন আমেরিকান বন্দির সঙ্গে অন্য চারজনের মৃতদেহ হস্তান্তর বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং হামাসের মধ্যে সরাসরি আলোচনায় নেতানিয়াহুও বিচলিত হয়ে পড়েন।
এরপর নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনাকে ভন্ডুল করার একটি উপায় খুঁজে পান। তিনি প্রথম ধাপের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবে রাখা হলো হামাস ইসরায়েলের ওপর কোনো নতুন শর্ত ছাড়াই আরও বন্দিদের মুক্তি দেবে। হামাস তখন যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তি মেনে চলার ওপর জোর দেয়। কিন্তু নেতানিয়াহু চরম অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যের এক নির্লজ্জ আচরণ প্রদর্শন করলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন গাজায় মানবিক সহায়তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধের। তারপর শুরু করলেন ভয়াবহ বিমান হামলা। একই সঙ্গে স্থলেও চালালেন আরও সামরিক অভিযান। মূলত এটি ছিল নেতানিয়াহুর তরফ থেকে ফের যুদ্ধ শুরু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করল। দেখা গেল, খুব কম পশ্চিমা দেশই এ ব্যাপারে আপত্তি তুলল। যেসব দেশ আপত্তি তুলল, তাদের আপত্তিও ধোঁয়াশা। সেসব কথার তেমন কোনো অর্থ দাঁড়ায় না।
এভাবেই নেতানিয়াহু তার যুদ্ধ ফিরে পেলেন। তবে যুদ্ধ নিয়ে এবার রয়েছে তার আরও বিস্তৃত পরিকল্পনা। তা হচ্ছে, একটি চূড়ান্ত সমাধান—গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করার মহাপরিকল্পনা।
এদিকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত না করেই গাজা পুনর্গঠন, হামাসকে শাসক টেকনোক্র্যাটদের বেসামরিক প্রশাসন দিয়ে প্রতিস্থাপন এবং পর্যবেক্ষক মোতায়েনের লক্ষ্যে আরবদের বহু বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা গ্রহণ ইসরায়েলকে অস্থির করে তুলেছিল। পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়েছিল কায়রোতে একটি জরুরি আরব শীর্ষ সম্মেলনে। সেসময় সৌদি আরবসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপসাগরীয় রাষ্ট্র এই পরিকল্পনা সমর্থন করেছিল।
আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রস্তাবটি ছিল ট্রাম্পের গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’ হিসেবে রূপান্তরিত করার এবং জোরপূর্বক দুই মিলিয়ন ফিলিস্তিনিকে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত করার অযৌক্তিক পরিকল্পনার জন্য চরম প্রত্যাঘাত। নেতানিয়াহু এখন ট্রাম্পের বাগাড়ম্বরের সুযোগ নিয়ে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনকারী সেই আরব পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করার পাঁয়তারা করছেন। তার এ পাঁয়তারা যুদ্ধ শেষ করার নয়; বরং যত সম্ভব ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং তাদের বাস্তুচ্যুতকে ত্বরান্বিত করার। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, নেতানিয়াহু ও তার নির্বাচিত জেনারেলরা সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কতদূর যেতে পারেন, তার কোনো সীমা কল্পনা কঠিন।
অত্যন্ত বিস্ময়র হলেও সত্য যে, গাজাবাসীর জন্য এখন একমাত্র আশা যেটা জেগেছে, তা ইসরায়েলের ভেতর থেকেই। ইসরায়েলি বন্দিদের পরিবার জানে যে, নেতানিয়াহু কয়েক মাস আগেই তাদের প্রিয়জনদের মুক্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তারা জানে যে, হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তাদের অংশে অটল থাকতে আগ্রহী ছিল। এ ছাড়া হামাসের অন্য কোনো বিকল্পও ছিল না। কিন্তু এটা নেতানিয়াহুর পছন্দ ছিল না। তবে এখন ইসরায়েলে তৈরি হচ্ছে এক ভয়ানক বিপর্যয়। অর্থাৎ ঘরের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। আর এর নেতৃত্বে রয়েছে বন্দিদের পরিবারগুলো। পাশাপাশি এ আন্দোলনে রয়েছে দেশটির সেই সব মানুষ, যারা নেতানিয়াহুকে মনে করেন একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক এবং ইসরায়েলের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে বিপন্নকারী হিসেবে।
নেতানিয়াহুর কাছে গত ১৮ মাসে ইসরায়েলের ভূ-রাজনৈতিক সাফল্য এ অঞ্চলে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ এক সুযোগ। এই বিশাল প্রচেষ্টায় বা সাফল্যের জন্য কয়েকজন ইসরায়েলি বন্দি এবং কয়েক মিলিয়ন ফিলিস্তিনির ভাগ্য গ্রহণযোগ্য মূল্যই। তার মানে, নেতানিয়াহুর কাছে কয়েকজন ইজরায়েলি বন্দি এবং লাখ লাখ ফিলিস্তিনির জীবনের চেয়ে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই অনেক বড়!
লেখক: আম্মামভিত্তিক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্চয় কুমার হালদার
মন্তব্য করুন