বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে যে একতরফা প্রচার হয়েছে, তার অধিকাংশ যেমন সত্য-বিবর্জিত, তেমনি মনগড়াও। বিশেষত তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী এবং তাদের বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এককভাবে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব দিতে গিয়ে অন্যদের অবদানকে অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু আগুন যেমন ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় না, তেমনি মিথ্যার প্রলেপে ঐতিহাসিক সত্যকেও ঢেকে রাখা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাতে আর কারও কোনো ভূমিকা বা অবদান নেই এটাও সঠিক নয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অন্যদের ভূমিকাকে যথাযথ মূল্যায়ন ও সম্মান দেখিয়েও বঙ্গবন্ধুকে মহানায়কের আসনে বসানো সম্ভব, তা তারা বিস্মৃত হয়েছিলেন।
এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর স্তব্ধ বাংলাদেশে প্রথম উচ্চকিত হয়েছিল মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ। অথচ লীগ-নেতারা মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়ার অবদানকে কখনোই স্বীকার করতে চান না। বরং জিয়াকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার কষ্টকর চেষ্টা তাদের কথাবার্তায় লক্ষ করা যায়। কখন কোন পরিস্থিতিতে মেজর জিয়া পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তা আজ সর্বজনবিদিত। ইতিহাসে তা লিপিবদ্ধ আছে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর ‘উই রিভোল্ট’ বলে নিজের কমান্ডে থাকা সৈনিকদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর জিয়া। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি কমান্ডার লে. কর্নেল জানজুয়াকে গ্রেপ্তার ও হত্যার মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল তার সে বিদ্রোহ, যা পরবর্তী একদিনের মধ্যে রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে জিয়া তার ট্রুপস নিয়ে অবস্থান নেন কর্ণফুলী নদীর অন্য পাড়ে পটিয়ায়।
এদিকে ২৬ মার্চ সকালে ঘটে আরেক ঐতিহাসিক ঘটনা। রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একটা কিছু করার উপায় খুঁজছিলেন। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্রের দুটি স্টেশন ছিল। একটি আগ্রাবাদে, আরেকটি কালুরঘাটে। সেদিন সেই কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্রেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। এটা ছিল একটি দুঃসাহসী পদক্ষেপ। ২৬ মার্চ সারা দিন মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে কথিকা ও দেশাত্মবোধক গান প্রচার করা হয় সেখান থেকে। এ সময় উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন রেডিও স্টেশনটির নিরাপত্তা নিয়ে। তারা জানতে পারেন, একজন বাঙালি মেজর বিদ্রোহ করে তার সৈন্যদের নিয়ে পটিয়ায় অবস্থান করছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ তার ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইয়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। ২৭ মার্চ তিনি তার বন্ধু মাহমুদ হোসেন ও আগ্রাবাদ হোটেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক ফারুক চৌধুরী (শেষের দুজন ২৮ মার্চ ভারতে যাওয়ার পথে শহীদ হন) হোটেলের জিপ নিয়ে পটিয়ায় গিয়ে জিয়াকে সব জানান এবং অনুরোধ করেন বেতার কেন্দ্রটিতে পাহারার ব্যবস্থা করতে। সেখান থেকে তিন লরিভর্তি সৈন্য নিয়ে মেজর জিয়া তাদের সঙ্গে কালুরঘাটে আসেন। একপর্যায়ে একটি কক্ষে বেলাল মোহাম্মদ মেজর জিয়াকে একা পেয়ে বললেন, “আচ্ছা মেজর সাহেব, আমরা তো সবাই ‘মাইনর’, আপনি ‘মেজর’ হিসেবে স্বকণ্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়?” হাস্যচ্ছলে কথাটি বললেও জিয়া তা সিরিয়াসলি গ্রহণ করেন। তারপর একটি সাদা কাগজে জিয়া প্রথমে লেখেন, ‘আই মেজর জিয়া ডু হিয়ার বাই ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ’। এ সময় বেলাল মোহাম্মদ বলেন, ‘দেখুন, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বলবেন কি?’ ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন’ বলে জিয়া সে সঙ্গে যোগ করেন, ‘অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ (সূত্র: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র; বেলাল মোহাম্মদ: পৃষ্ঠা-৪০)। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার অধিবেশনে এ ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করা হয়। তারপর একটু পরপরই তা প্রচার হতে থাকে পরদিন পর্যন্ত। মেজর জিয়ার এ ঘোষণা সারা দেশে বিদ্যুদ্বেগে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই জেনে যায় জিয়া নামে একজন বাঙালি মেজর পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। কীভাবে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে, কীভাবে বিদ্রোহী বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় মিলিত হয়ে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে যুদ্ধ কৌশল ঠিক করেছে, কীভাবে সেক্টর এবং পরবর্তী সময়ে নিয়মিত ব্রিগেড গঠিত হয়েছে, তা সবাই অবগত। এখানে আমি শুধু আলোচনা করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের একজন মহান বীরকে হেয়প্রতিপন্ন করতে আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রী-যন্ত্রীরা যে নির্জলা মিথ্যার বেসাতি করেছেন, তা নিয়ে।
মেজর জিয়ার সে ঘোষণায় সেদিন হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নেতৃত্বহীন হতবিহ্বল বাঙালি জাতি সম্বিত ফিরে পেয়েছিল। তারা অনুপ্রেরণা পেয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। কাউকে ছোট করার অভিপ্রায়ে নয়, ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই বলতে হচ্ছে, জিয়া ছাড়া আর কারও কণ্ঠে সেই কঠিন সময়ে স্বাধীনতার বাণী উচ্চারিত হয়নি। মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতা যুদ্ধের সে ঘোষণা যারা শুনেছিলেন, সেই অসংখ্য মানুষের মধ্যে অন্যতম একজন বঙ্গবন্ধুর মেয়েজামাই ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। তিনি তার লেখা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু স্মৃতি ও বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঘোষণায় বার বার বলা হচ্ছিলো যে, মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। এর কিছুক্ষণ পর শোনা গেল, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সর্বত্র আমরা পাকিস্তানী হানাদারদের পর্যুদস্ত করে চলেছি। ইনশাআল্লাহ আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশকে আমরা শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হবো। জয় বাংলা।” স্ত্রী শেখ হাসিনা ও তিনি একসঙ্গে খিলগাঁওয়ে জনৈক ড. মোজাম্মেলের বাসায় বসে এ ঘোষণাটি শুনেছিলেন বলে এম এ ওয়াজেদ মিয়া উল্লেখ করেছেন। (পৃষ্ঠা: ৮০)।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করাতে ব্যর্থ হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম সেখান থেকে বেরিয়ে রায়েরবাজারে আত্মগোপন করেন। পরদিন বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে চলে যান ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জ এলাকায়। তারপর অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হন। এ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম তার ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তারা অবস্থান করছিলেন আকারপাড়া নামে এক গ্রামে। আমীর-উল-ইসলাম লিখেছেন, ‘স্নান করে খেতে যাব, হঠাৎ স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান ভেসে আসল। ঘোষক বেতারে বলছেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজির হতে বেতারে নির্দেশ দেয়া হলো। প্রথমে এদের নামধাম কিছুই বোঝা গেল না। ঠাওর করতে পারলাম না, কারা কোত্থেকে এই বেতার চালাচ্ছে। পরে বেতারে মেজর জিয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। মেজর জিয়ার আহ্বান বেসামরিক, সামরিক তথা বাংলার সর্বশ্রেণির মানুষকে সংগ্রামে উজ্জীবিত করে।’ (পৃষ্ঠা-২৭)। একই দিনে মেজর জিয়ার ঘোষণা শোনার কথা তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানও তার ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ২৬ মার্চ সকালে বুড়িগঙ্গা নদী পার হই। ২৬-২৭ মার্চ কেরানীগঞ্জে মন্টুদের (মোস্তফা মোহসীন মন্টু) এলাকায় ছিলাম। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনি।’ (আমি সিরাজুল আলম খান; পৃষ্ঠা-১৩৩)।
ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (পরে বিএনপি নেতা ও মন্ত্রী) শাহজাহান সিরাজ বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চ রাতের এই ভয়াবহ ঘটনার পর আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। আমাদের সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে ঢাকা থেকে পালাতে গিয়ে নদীর অপর পাড়ে চট্টগ্রাম থেকে জিয়ার ঘোষণা শুনতে পাই। তখন আমরা আশার আলো পাই এবং সীমান্ত পাড়ি দিই (বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস; ড. মোহাম্মদ হান্নান, পৃষ্ঠা-৩৪০)। একই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক ১৯৮৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক মেঘনা’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২৭ তারিখ (মার্চ ’৭১) সকালে চায়না বিল্ডিংয়ের (আজিমপুর) কাছে বন্ধু আতিয়ারের বাসায় গেলাম। তার কাছ থেকে একটা লুঙ্গি, একটা হাফ শার্ট নিয়ে রওনা হলাম নদীর ওপারে। জিনজিরায় নদী পার হয়েই রওনা হলাম গগনদের বাড়িতে। পথে দেখা হলো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। পরে একে একে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে একজন লোক। তার ঘাড়ে ইয়া বড় একটি ট্রানজিস্টার। আমরা যাব বালাদিয়া। নৌকায় শুনলাম হঠাৎ বেতারযন্ত্র থেকে বলা হচ্ছে, ‘আই মেজর জিয়াউর রহমান ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ’। কিছুক্ষণ পরে আবার শুনলাম, জিয়া বলছেন—‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’
ওপরের কথাগুলো আমার বানানো নয়। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ, তাদের লেখা বইয়ের উদ্ধৃতি মাত্র। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা বা অবদান যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রতিষ্ঠার বিষয় নয়। এটি ঐতিহাসিক সত্য। কারও মুখের কথায় বা কলমের খোঁচায় সে সত্য মিথ্যে হয় যাবে না। এটাও স্বীকার্য, ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর আগে-পরে শেখ মুজিব স্বকণ্ঠে স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি। তা সত্ত্বেও তিনিই ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ। সেইসঙ্গে এ মহান যুদ্ধে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখেছেন, তাদের অবদানকেও স্বকৃতজ্ঞচিত্তেই আমাদের স্মরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভুল বা অসত্য তথ্যের ওপর কোনো জাতির টেকসই ইতিহাস নির্মিত হতে পারে না, হলেও তা স্থায়িত্ব পায় না। (ক্রমশ)
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
l প্রকাশিত দুটি নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব
মন্তব্য করুন