আজ ভয়াল ২৫ মার্চ—গণহত্যা দিবস। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতি ও তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে ফেলার লক্ষ্যে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিষয়টি সামনে এনে ২০১৭ সাল থেকে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়। তবে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় এ নিয়ে প্রচেষ্টা চালালেও সত্যিকার অর্থে তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে সফলতাও আসেনি। মুক্তিযুদ্ধে মহান বিজয়কে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, গণহত্যা ও নির্মমতার বিষয়টিতে ততটা গুরুত্ব পায়নি। স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য হয়নি। কারণ সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে কোন দেশ কী ভূমিকা পালন করেছিল, সে বিষয়টি সামনে চলে আসত। ফলে যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের যে আত্মত্যাগ, সে প্রসঙ্গটিও আড়ালে পড়ে যায়। ইতিহাসের এ ভারসাম্যহীনতা দূর করতে এবং গণহত্যায় দায়ীদের বিচারের স্বার্থেও এ স্বীকৃতির দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশনের নির্বাহী পরিচালক এলিসা ভন ফরগের মতে, বিশ্বে গণহত্যা বন্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় গণহত্যার স্বীকৃতি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পাকিস্তান কখনো বাংলাদেশে গণহত্যায় তাদের দায় স্বীকার করেনি। শুধু তাই নয়, সেসময়ে পাকিস্তানের সমর্থক ও মিত্ররাও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দায় এড়াতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেসস্টাডি হিসেবে পড়ানো হয়। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। উল্লেখ্য, সংস্থাটি ২০২২ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত একাত্তরে গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের অভিযান চালায়। এতে প্রায় ৫০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়। এরপর যুদ্ধের ৯ মাসে হত্যা করা হয় ৩০ লাখ মানুষ। গবেষকদের মতে, যে দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়, তারা ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন ওই গণহত্যার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকার করে—তখন তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার বিবেচনায় আসে। কোনো গণহত্যাকে বিশ্বসম্প্রদায় যখন স্বীকার করে, তা যদি সংসদ বা নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও হয়, তখন তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বলা যায়। আবার কোনো গণহত্যাকে যদি জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলেও তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত। গণহত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনা মনে করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও পূর্ব ইউরোপে ইহুদি নিধনকে। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে আর্মেনিয়ার গণহত্যাসহ রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার গণহত্যা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালত স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসঙ্ঘের কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করেছে। পাশাপাশি জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি অতীতে সরকার প্রধানরা বারবার দাবি তুলেছেন। হতাশার কথা, প্রতিবছর দিনটি এলেই শুধু দাবিটির পক্ষে আওয়াজ শোনা যায়। পরে হারিয়ে যায়।
সম্প্রতি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যদিও স্থিতিশীল নয়। তারপরও বর্তমান সরকার বিষয়টিতে উদ্যোগী হবে—এ প্রত্যাশা সবার। মনে রাখতে হবে, যতক্ষণ দেশের কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি প্রবাসী জনগোষ্ঠীকে এ দাবির সঙ্গে যুক্ত করা না যাচ্ছে; বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা, প্রামাণ্য দলিল এবং ক্রমাগত প্রচারণা চালানো না যাচ্ছে, ততক্ষণ এ স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আন্তরিকভাবে তৎপর হলে এ স্বীকৃতি পাওয়া অসম্ভব নয়। বিস্মৃত হলে চলবে নাযে, এ দাবি কোনো করুণা ভিক্ষা নয়। গণহত্যা মানবসভ্যতাকেই বিপর্যস্ত করবে। বিশ্ব বিবেককে এটি অনুধাবন করতে হবে।
মন্তব্য করুন