জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য নথি। এটি শুধু পরিচয় ও নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়, বরং ব্যাংকিং, ভোটাধিকার, সরকারিসেবা গ্রহণ; এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ এটি অপরাধী শনাক্তকরণ, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং আইন প্রয়োগে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মোদ্দা কথা, নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে এনআইডি একজন ব্যক্তিবিশেষের জাতীয় পরিচয়ের একক।
বাংলাদেশে এনআইডি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কোন সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকবে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। নির্বাচন কমিশন দ্বারা বর্তমানে এটি পরিচালিত হলেও অনেকেই মনে করেন, এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকা উচিত। এ চাওয়ার পেছনে যথেষ্ট উপযুক্ত কারণও রয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ, এটি শুধু ভোটাধিকার ব্যবস্থাপনার বিষয় নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার সঙ্গেও জড়িত। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ নির্বাচন পরিচালনা করা আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য দক্ষ ও কার্যকর সংস্থা।
বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্য চুরি, জালিয়াতি এবং সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের জাতীয় পরিচয় ব্যবস্থাপনায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি যুক্ত করেছে, যা তথ্যকে সুরক্ষিত রাখে এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের কোনোরকম পরিবর্তন বা চুরি অসম্ভব করে তোলে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি এমন একটি ডিজিটাল লেজার ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি তথ্য অপ্রতিরোধ্য ও স্বচ্ছভাবে রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশও যদি আধুনিক ও নিরাপদ এনআইডি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, তাহলে ব্লকচেইনভিত্তিক এনআইডি ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। আর সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনেই কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত।
যদি এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাখা হয়, তাহলে এটি পাসপোর্ট, পুলিশ ডাটাবেজ ও জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য জাতীয় সেবার সঙ্গে সহজে একীভূত করা সম্ভব হবে। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রমে সংগতি আসবে। জনগণেরও সুবিধা হবে। এর মাধ্যমে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জনগণের আস্থা অর্জন সহজ হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্লকচেইন ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এনআইডি ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে উন্নত করতে সক্ষম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনআইডি বাস্তবায়ন দেশের নিরাপত্তা ও আস্থা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল এনআইডি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য কিছু বিষয় ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত, এনআইডি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা; যার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত হবে। এই কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ডিজিটাল পরিচয়পত্রের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করা সম্ভব; যা সিস্টেমের সঠিক কার্যক্রম নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়ত, ব্লকচেইনভিত্তিক ডিজিটাল এনআইডি সিস্টেমের প্রোটোটাইপ তৈরির সময় সুরক্ষা এবং গোপনীয়তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। তৃতীয়ত, ব্লকচেইন কেওয়াইসি পাইলট প্রকল্প চালু করা। চতুর্থত, সিস্টেমের সফল ইন্টিগ্রেশন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতা গড়ে তোলা।
ডিজিটাল এনআইডি সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি সম্পর্ক আরও সহজ ও দ্রুততর হবে। দেশকে ডিজিটালি রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে এ কার্যক্রমে। সর্বোপরি সরকারের উচিত এনআইডি ব্যবস্থাপনাকে শুধু একটি ভোটাধিকার নথি হিসেবে না দেখে একটি সর্বজনীন প্রশাসনিক ও নিরাপত্তামূলক নথি হিসেবে বিবেচনা করা। পাশাপাশি একে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন হস্তান্তর করা। একই সঙ্গে ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে এটি হবে বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি
মন্তব্য করুন