ট্রেনের টিকিট নিয়ে কালোবাজারি দেশের রেলওয়েতে নতুন কিছু নয়। কালোবাজারি চক্রগুলোর সারা বছরের পেশা এটি আর যাত্রীদের সারা বছরের কপালের ফের! তবে ঈদের মতো উৎসবগুলো কেন্দ্র করে এ চক্রগুলোর তৎপরতা অন্যান্য সময়ের থেকে বৃদ্ধি পায়, এই যা। এ ভূমিকাটি দেখে ‘অতি সরল’, ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ কিংবা ‘এটি মেনে নিয়েই চলতে হবে’—ধরনের অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত টিকিট নিয়ে দীর্ঘদিনের বাস্তবতা এমনই! কেননা বাস্তবে এসব চক্রের হাত থেকে ট্রেন যাত্রীদের ভ্রমণসংক্রান্ত স্বস্তি নিশ্চিত করতে, বিশেষ করে টিকিট-সংক্রান্ত এ যাবৎ যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা সবই অকার্যকর।
আমরা জানি, গত দুই দশকে রেলওয়ের টিকিট বিক্রির পদ্ধতি ও অপারেটরই বদলেছে কয়েকবার। নিজের আইডি দিয়ে নিজের টিকিট করতে রেলওয়েতে ‘রেলসেবা’ নামের অ্যাপস সুবিধাসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। থামানো যায়নি সিন্ডিকেট গড়ে ‘টিকিট কালোবাজারি’র মতো ভয়াবহ অপকর্ম। রোববার কালবেলায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে টিকিট কালোবাজারির বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলওয়ের ‘রেলসেবা’ অ্যাপসের জন্য যাত্রীদের ফোন নম্বর ও এনআইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা আইডি ব্যবহার করে নিজেদের ইচ্ছামতো অনলাইনেও টিকিট হাতিয়ে নিচ্ছে কালোবাজারি চক্র। শুধু তাই নয়, এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ খোদ সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও। পাশাপাশি কালোবাজারিদের টিকিট বাজারজাতকরণে বা এসব টিকিটের যাত্রী জোগাড় করতে কাজ করছে একশ্রেণির আবাসিক হোটেল বয়, ক্লিনার, পাঠাও চালক এবং স্টেশনে অবস্থিত ছোট ছোট দোকান কর্মচারী। এ চক্র কালোবাজারিদের মাধ্যমে সংগৃহীত টিকিট নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে বিক্রি করছে।
কালবেলার কাছে একাধিক ব্যক্তি তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন। তারা নিজেদের টিকিট অনলাইন থেকে কাটতে গিয়ে দেখেছেন, তাদের আইডি কার্ড ব্যবহার করে অন্য কেউ টিকিট কেটে নিয়েছে! এ বিষয়ে অ্যাপস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, কোনো যাত্রীর রেজিস্ট্রেশন করা আইডি থেকে অন্য কেউ রেলের টিকিট কাটলে তা শুধু দুভাবে সম্ভব। প্রথমত ম্যানেজমেন্টের কেউ সার্ভার থেকে অ্যাকসেস নিয়ে এ অপকর্ম করতে বা করাতে পারে। আর দ্বিতীয়ত সিস্টেম লেভেলে সিকিউরিটির দুর্বলতা। অর্থাৎ অনলাইন টিকিট ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্তদের যোগসাজশ ছাড়া এমনটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কমলাপুর রেলস্টেশনে নির্দিষ্ট কোন কোন কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়ে কারসাজি হচ্ছে, তাও উপস্থাপিত হয়েছে প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ট্রেনযাত্রীদের টিকিট ভোগান্তি নিরসনে পুরো প্রক্রিয়া প্রযুক্তিনির্ভর বা ডিজিটাল হলেও ভোগান্তি কি দূর হলো? নাকি সমস্যার ও কালোবাজারির শুধুই ডিজিটাল রূপান্তর ঘটল? তা না হলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন কালোবাজারি থামানো যাচ্ছে না? স্মরণে রাখা জরুরি, তথ্যপ্রযুক্তি কোনো জাদুমন্ত্র নয়। ডিভাইস কিছু সমাধান করে না। করে মানুষ। এটি কাজকে দ্রুত, সহজলভ্য, সহজবোধ্য করে। সমাধানের উদ্ভাবনী পন্থার সুযোগ তৈরি করে। কিন্তু দিনশেষে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব মানুষেরই। সেই মানুষ অর্থাৎ রেলওয়ে কর্মকর্তারাই যদি এটাকে হীনউদ্দেশ্যে ব্যবহার করে, তাহলে সুফল মিলবে কীভাবে? সুতরাং আমরা মনে করি, টিকিট কালোবাজারি বন্ধে সর্বপ্রথম সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ ভূত খুঁজে বের করতে হবে। কাজটি এমন কোনো কঠিন কাজ নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি। পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতির যেসব দুর্বলতা-অক্ষমতা রয়েছে, সেগুলোর উন্নতি দরকার। আমাদের প্রত্যাশা, ঈদে যাত্রীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তৎপর হবেন।
মন্তব্য করুন