গত কয়েক দশক ধরে অভিন্ন নদী বিষয়ে আন্তর্জাতিক নীতি নিয়মের তোয়াক্কা না করে ভারত তিস্তা নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে। বিগত সরকারগুলোর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং উজানের দেশগুলোর স্বার্থপরতা ও অন্যায় আচরণের কারণে কোনো অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যাই বাংলাদেশ আদায় করতে পারেনি। এমনকি গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি থাকার পরও বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যার পানি বেশিরভাগ সময়ই বুঝে পায়নি। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের গড়িমসি এবং অন্যায় আচরণ অভিন্ন নদীবিষয়ক বিদ্যমান ও গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সুস্পস্ট লঙ্ঘন।
তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে বিগত সরকার চীন সরকারের শরণাপন্ন হয় এবং অনুরোধ করে যেন দেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। যাতে করে শুকনো মৌসুমে পানি সমস্যার সমাধান হয়। সেই লক্ষ্যে চীনের একটি সংস্থা তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে তিস্তা নদীর বর্তমান প্রশস্ততা ৫ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে এক কিলোমিটারেরও কম করা হবে এবং খনন করে নদীর গভীরতা ৫ মিটার থেকে বাড়িয়ে ১০ মিটার করা হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী সংকুচিত করে আনার কারণে নদীর দুই পাড়ে প্রায় ১৭০ বর্গকিলোমিটার জমি উদ্ধার করে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপন করা হবে।
প্রস্তাবিত এ প্রকল্প বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং প্রকৃতি বিরোধী। এ প্রকল্পের ফলে সরু নদীতে বর্ষাকালে স্রোতের তীব্রতা অনেক বেড়ে যাবে এবং নদীভাঙন ও বন্যার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। ব্যাপক পলি ভরণের ফলে সরু এবং সরলীকরণকৃত নদীটির নাব্যও হ্রাস পাবে। বিগত সরকারের আমলে ভারত চীনের এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং ন্যায্য পানি হিস্যার বিষয় পুরোপুরি অবজ্ঞা করে চীনের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা তারা নিজেরাই করে দেবে বলে ঘোষণা করে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আবার চীনের কাছেই ফেরত গিয়েছে তাদের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। সেই লক্ষ্যে এ মহাপরিকল্পনা নিয়ে আবারও গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে এবং সরকার গণশুনানির আয়োজন করেছে।
যেহেতু প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে এবং কার্যকারিতার ব্যাপারে ভিন্নমত রয়েছে, তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে প্রস্তাবিত এ মহাপরিকল্পনার বিপরীতে অন্য কোনো স্থায়িত্বশীল এবং বিজ্ঞানসম্মত সমাধান আছে কি না। মহাপরিকল্পনার বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে দশ দফার একটি প্রস্তাব সর্বসাধারণের মতামত ব্যক্ত করার এবং সরকারের বিবেচনার জন্য পেশ করছি।
এক. সরকার তিস্তা নদীর ভারত ও সিকিমের অংশে গাজলডোবা এবং অন্যান্য প্রবাহ-নিয়ন্ত্রণকারী স্থাপনা নির্মাণের পূর্বের ঐতিহাসিক প্রবাহের ভিত্তিতে পানির ন্যায্য হিস্যার দীর্ঘমেয়াদি এবং বছরের ১২ মাসব্যাপী চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অংশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান রাখা ও জলজ পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পানি প্রাপ্যতার চুক্তি করার সব উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানকল্পে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে ও প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক প্রচলিত আইনের আওতায় স্থায়ী সমাধান করতে সময়ক্ষেপণ না করে এখনই উদ্যোগ নেবে।
দুই. গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনীতির ক্ষেত্রে পানি-কূটনীতিকে সব কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার বিনিময়ে ট্রানজিট ও অন্যান্য বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার শর্ত আরোপ করবে।
তিন. তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক ভূগঠনিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ বজায় রেখে পানি ও পলি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে খননকাজ চালাতে হবে এবং খননকৃত পলিবালু যাতে করে আবার নদীবক্ষে ফেরত যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে পলিবালুর অন্যান্য ব্যবহার উপযোগিতা যাচাই করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে নদীপাড়ে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। খননকৃত পলিবালুর খনিজ উপাদান নিরীক্ষা করে এবং বিভিন্ন কণার আকার অনুযায়ী নির্মাণসামগ্রী ও নদীপাড় ভাঙন রক্ষার জন্য ব্যবহৃত জিও-ব্যাগ (geo-bag) ভর্তি করে নদীভাঙন এলাকায় ব্যবহার করতে হবে। তা ছাড়া অন্যান্য দেশজ পদ্ধতির মাধ্যমে নদীভাঙন রোধ করা উদ্যোগ নেবে এবং নদীর প্রতি বেষ্টনী পদ্ধতির বদলে নদী-প্লাবনভূমির জৈবিক সংযোগ স্থাপনকারী পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি গ্রহণ করবে।
চার. যেহেতু জিও-ব্যাগ ব্যবহার অনেক বেশি প্রকৃতিবান্ধব এবং কার্যকর বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, তাই একান্তই প্রয়োজন ছাড়া এযাবৎকালে ব্যবহৃত নদীপাড়ে বাঁধ নির্মাণ এবং গ্রোয়ান নির্মাণের মতো বেষ্টনী পদ্ধতির মাধ্যমে নদীপাড় ভাঙন রোধের প্রকল্প থেকে সরে এসে জিও-ব্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে নদীপাড় ভাঙন রোধের ব্যাপক প্রকল্প নিতে হবে এবং এ কাজে খননকৃত পলিবালু ব্যবহার করতে হবে।
পাঁচ. তিস্তা সেচ অঞ্চলে বিদ্যমান সব মজে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধার করে খননের মাধ্যমে বর্ষাকালে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে প্রয়োজনীয় সেচের কাজে পরবর্তীকালে এই পানি ব্যবহার করা যায়।
ছয়. তিস্তা নদীবক্ষে যেসব চর রয়েছে যেখানে এরই মধ্যে কৃষিকাজ এবং বসতি গড়ে উঠেছে, সেসব মানুষের জীবনমান উন্নত করার সব উদ্যোগ নিতে হবে। চরে অবস্থিত বাড়িঘর রক্ষার লক্ষ্যে ভিটার উচ্চতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
সাত. তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলে পলিভরণের মাধ্যমে নদীটি সংকুচিত হয়ে মাত্র ৭০০ মিটার প্রস্থে পরিণত হয়েছে। যেহেতু নদীর উজানের সব পানি এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাই প্রবাহ ধারণের প্রয়োজন অনুযায়ী এখানকার প্রস্থ বৃদ্ধিকল্পে খনন করতে হবে।
আট. তিস্তা অববাহিকার সেচনির্ভর এলাকার আকার বাস্তবসম্মত রাখতে হবে। বর্তমান ও নিকট অতীতে প্রাপ্য পানির মাধ্যমে সম্ভাব্য সেচ প্রকল্পের আকারের তুলনায় প্রস্তাবিত সেচ প্রকল্পের আকার অনেক বড়। পানি প্রাপ্যতা বাড়াতে না পারলে প্রস্তাবিত সেচ অঞ্চলে সেচ কার্যক্রম চালু রাখা বাস্তবসম্মত হবে না। প্রয়োজনে কৃষি ফলনের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে।
নয়. বুড়ী তিস্তাসহ তিস্তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য উপনদী ও শাখা নদীগুলোকেও প্রয়োজনীয় খননের মাধ্যমে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং সব নদী যাতে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত ও নির্ভরশীল থাকে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে হড়কা বন্যা কিংবা অন্যান্য বন্যার সময় পানি পুরো অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বন্যার ক্ষতি সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে।
দশ. তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলে ভূমির ধরন আমলে নিয়ে কৃষিশিল্প এবং নির্মাণসামগ্রী প্রস্তুতকারক শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের শিক্ষার হার এবং গড় আয়ের তুলনায় তিস্তা অববাহিকার মানুষও জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ পায়। অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে সারা দেশেই যেন সাম্যের ভিত্তিতে ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা যায়, সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন