বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ আলোচিত হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে অধস্তন আদালতের দেওয়া রায় পুরোটাই বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এটি নিঃসন্দেহে বর্বরোচিত এক হত্যাকাণ্ডের শিকার আবরারের প্রতি ন্যায়বিচারের প্রতিফলন।
গত রোববার এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল শুনানি করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ধরনের রায়ের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় ডিসিপ্লিন আনার জন্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের প্রতি যে ধারণা, সে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলো। রায় ঘোষণার পর হাইকোর্টের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। রায় যাতে অতিদ্রুত কার্যকর হয়—সেটাই এখন আমাদের চাওয়া। পাশাপাশি ভবিষ্যতে আর কোনো বাবা-মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়।
আমরা জানি, বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন আবরার ফাহাদ। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন তিনি। ওই হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে সে সময় উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েটসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেইসঙ্গে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে তৎকালীন সরকার। এ ঘটনার জের ধরেই তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরদিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা। মাত্র ৩৭ দিনে তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এ মামলায় আরও পাঁচ শিক্ষার্থীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ডেথ রেফারেন্স ও এসব আপিলের ওপর একসঙ্গে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে হাইকোর্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এরপর মামলাটি রায়ের জন্য রোববার আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে। এদিন হাইকোর্ট আসামিদের ডেথ রেফারেন্স অনুমোদন করেন। খারিজ করেন আপিলগুলো। এর ফলে বিচারিক আদালতের দণ্ডাদেশ বহাল থাকে। ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। আসামিদের মধ্যে চারজন বাদে বাকি সবাই কারাগারে আটক রয়েছেন।
ন্যায়বিচারের পক্ষে হাইকোর্টের এ রায়কে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমরা মনে করি, এ রায় একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী খুনিরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন, দেশের বিচারব্যবস্থার মধ্য দিয়েই তাদের যে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত সম্ভব—এ রায় তারই নজির হয়ে থাকবে। পাশাপাশি বিশেষ করে দেশের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা, তাদের জন্যও একটি স্পষ্ট বার্তা রয়েছে এর মধ্যে। সেটা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে কল্যাণ-মঙ্গলের রাজনীতি করা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভিন্নমতের শিক্ষার্থী বা সহপাঠীর ওপর দমনপীড়নের রাজনীতি পরিত্যাগ করা। আমরা চাই না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। আমাদের প্রত্যাশা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আদালতের এ রায় সঠিক সময়ে কার্যকর করা হবে।
মন্তব্য করুন