বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে, যার মোকাবিলায় যুবসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বাস্তবতায় সম্প্রতি (২০-২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) ভারতের নয়াদিল্লির বিশ্ব যুবক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বিমসটেক যুব নেতৃত্বাধীন জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ সম্মেলন শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করার একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল না, বরং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করেছে। এখানে যুবসমাজ কীভাবে নিজেদের ভূমিকা আরও কার্যকর করতে পারে, সে সম্পর্কে দীক্ষা লাভ করেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইডস কর্তৃক আয়োজিত এ সম্মেলনে বিমসটেকভুক্ত সাতটি দেশের (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড) ১২২ জন যুব প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ১৪ জন, যার মধ্যে ৩ জন রোভার স্কাউট লিডার ও ১১ জন রোভার স্কাউট। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা একত্রিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন।
এ অনুষ্ঠান আমার জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল, যখন আমি দেখলাম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যুব প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরছেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের সেশনে উপস্থিত ছিলেন ড. আনন্দজিৎ গোস্বামী, যিনি আমাদের পৃথিবী সম্পর্কে অত্যন্ত শিক্ষামূলক ধারণা প্রদান করেন। তিনি পৃথিবীর উষ্ণায়ন এবং এর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তার উপস্থাপনা বাস্তবসম্মত ও সহজবোধ্য ছিল, যা আমাদের অনেককেই নতুনভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ সম্মেলন আমাদের শিখিয়েছে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সে লক্ষ্যে যুবসমাজকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অন্য এক সেশনে, ইউনিসেফের ড. নির্মা বোরার নেতৃত্বে জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার সঙ্গে যুক্ত শিশু অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি শিশু অধিকার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং ইউনিসেফের শিশুদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। এতে তিনি যুবকদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের দায়িত্ব ও উদ্যোগ গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ভারতের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক মন্ত্রী ড. মনসুখ মান্ডভিয়ার উপস্থিতি। তিনি ইন্ডিয়া নাইট শোয়ে অংশ নেন এবং তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তার উপস্থিতি আমাদের সবাইকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে, তিনি তরুণদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করার পদেক্ষপ গ্রহণ করার জন্য ভারত স্কাউটসের প্রশংসা করেন।
সম্মেলনের তৃতীয় দিনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেশন ছিল ‘কার্যকর যোগাযোগ এবং অ্যাডভোকেসি’, যা পরিচালনা করেন গুরজিৎ কৌর চাওলা, ডিন, ছাত্রকল্যাণ, মানব রচনা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজ। তিনি আলোচনা করেন কীভাবে কার্যকরভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ‘আমরা স্কাউট, আমরা পথপ্রদর্শক, আমরা রক্ষাকারী, আমরা ত্যাগী’—এ স্লোগানটি মনে রেখে তিনি শেখান কীভাবে আমাদের কথাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় বা অন্য কোনো মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করা যায় যাতে তা মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে পারে। সম্মেলনের চতুর্থ দিনে আমাদের জন্য একটি শিক্ষা সফর আয়োজন করা হয়, যেখানে আমরা বিমসটেক সচিবালয় এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করি। বিশেষভাবে, বিমসটেকের সুপার কম্পিউটার ল্যাব পরিদর্শনের সুযোগ পাই, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাস ও গবেষণা কীভাবে পরিচালিত হয়, তা সরাসরি দেখার সুযোগ হয়। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্লভ ও শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। শিক্ষা সফরের সময় আমাদের জানানো হয় যে, বিমসটেক এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গবেষণা, যুব নেতৃত্ব উন্নয়ন এবং স্কলারশিপ প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। বিশেষত পরিবেশ বিজ্ঞান, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষি নিয়ে গবেষণার জন্য বিমসটেকের একটি বিশেষ স্কলারশিপ প্রোগ্রাম চালু হতে যাচ্ছে, যা দ্বারা বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সরাসরি উপকৃত হবে।
সম্মেলনে আমাদের টিম ‘ভাসমান হাউস’ প্রজেক্টটি উপস্থাপন করে, যা সবার ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। এটি বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একটি অত্যন্ত উদ্ভাবনী ও টেকসই আবাসন সমাধান। বাংলাদেশে বন্যা একটি চলমান বিপর্যয়, যা প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে। দেশের নিম্নভূমি, যেখানে অধিকাংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ মিটার বা তারও নিচে, যা বন্যার সময় সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার স্বীকার হয়। বন্যার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য ‘ভাসমান হাউস’ প্রজেক্ট একটি কার্যোপযোগী আবাসন সমাধান প্রদান করবে, যা বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য উপযোগী। সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আর্মি চিফ জেনারেল দালবির সিং সুহাগ। তিনি সম্মেলনের গতি ও প্রাণশক্তির প্রশংসা করেন এবং ভবিষ্যৎ জলবায়ু নীতির জন্য এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। সম্মেলনের সুপারিশসমূহ বিমসটেক কর্মকর্তাদের কাছে তুলে দেওয়া হয়, যা উচ্চপর্যায়ে আলোচনায় যোগ্যতার জন্য অবহিত করা হবে। এ জলবায়ু কর্মকাণ্ডে দক্ষিণ এশিয়ার যুব নেতৃত্বকে আরও তীব্র ও কার্যকরভাবে একত্রিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে উঠেছে।
সম্মেলন শেষে আমি মনে করি যে আমরা সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি—
এক. জলবায়ু সচেতনতা কর্মশালা: স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
দুই. পরিবেশবান্ধব জীবনধারা প্রচার: প্লাস্টিক বর্জন, বনায়ন ও নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা।
তিন. স্থানীয় যুবদের সম্পৃক্ত করা: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করা।
চার. জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প: বন্যা, খরা ও অন্যান্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করা।
সম্মেলনটি আমাকে শুধু পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করেনি, বরং আমাদের স্কাউটদের এমন কিছু আদর্শ শেখাতে সাহায্য করেছে, যা আমাদের সমাজে পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা শুধু দেশেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক—এ লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করব। সম্মেলনটি আমার জন্য ছিল এক অভিজ্ঞতার সমাহার, যা আমাকে আমার দায়িত্ব আরও গভীরভাবে অনুভব করতে সহায়তা করেছে। আমি মনে করি, এটি আমাদের একটি বার্তা দেয় যে, কাজের মাধ্যমে, বিশেষ করে যুবসমাজের মাধ্যমে পৃথিবীকে আরও ভালো জায়গা নিয়ে যাওয়া সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আরও কিছু করতে হবে। আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, এ সম্মেলনে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে সবাই মিলিত হয়ে প্রকৃত পরিবর্তন আনব। বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা সম্মেলন থেকে অমূল্য শিক্ষা গ্রহণ করেছি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়েছি এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছি। এ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা আমাদের দেখিয়েছে যে, যুবকরাই শুধু ভবিষ্যতের নেতা নয়, বর্তমানেরও পরিবর্তনকারী শক্তি। আমরা বিশ্বাস করি যে, সম্মেলনের মাধ্যমে গৃহীত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরও পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
লেখক: (পিআরএস, উডব্যাজার) রোভার স্কাউট লিডার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এয়ার রোভার স্কাউট গ্রুপ
মন্তব্য করুন