বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১
অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৫ এএম
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালির আত্মমর্যাদা ও মার্চ

বাঙালির আত্মমর্যাদা ও মার্চ

মার্চ মাসকে আমরা স্বাধীনতার মাস বলে জানি। একাত্তরের মার্চ ছিল বাঙালি জাতির জ্বলে ওঠার মাস। একটি দেশ বা জাতি যেমন অতীত আঁকড়ে বাঁচে না; তেমনি অতীত ভুলেও বাঁচতে পারে না। অতীত তার শক্তি বর্তমান তার সাধনা। তাহলেই ভবিষ্যৎ হয় সফল। বাংলাদেশের মানুষ একাত্তর বা মার্চের গুরুত্ব ভুলে গেছে কিংবা ভুলে যাবে—এমন ভাবনা অলীক। নানা কারণে আমাদের বিতর্কিত ইতিহাস বা ঐতিহ্য বিপাকে পড়লেও ফের একসময় ঘুরে দাঁড়ায়।

আপনি যদি দুনিয়ার ইতিহাস দেখেন বা জানেন নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, বহু দেশে বহু ধরনের পরিবর্তন সে দেশের অনেক কিছু বদলে দিলেও মূল জায়গাগুলো থেকে যায়। যারা তা মানেননি কিংবা দম্ভ অহমিকা আর আত্মতৃপ্তিতে ভুগতেন আজ তারা নির্বাসিত। মুশকিল হচ্ছে, স্বাধীনতার মূল কথাই ছিল সংখ্যায় যদি একজনও হয় আর তিনি যদি ন্যায্য কথা বলেন, তবে তা গ্রহণ করা। এই গ্রহণ বর্জনের তফাতেই আজকের পরিস্থিতি এমন রূপ নিয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সামনে যাব? যদি যেতে হয়, আমাদের সুবর্ণ অতীত আর তার ফসল কাউকে এককভাবে না দিয়ে তা সর্বজনীন করে নিতে হবে। একটি সমাজের চালিকাশক্তি তার শিক্ষা ও আইনের শাসন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কোনোকালেই তেমনভাবে জায়গা নিতে পারেনি। অপরিমেয় মেধা আর উদ্ভাবনী শক্তির পরও আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি। যখনই কোনো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তখনই সমস্যা তাকে গ্রাস করেছে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিক্ষাই হচ্ছে এর টার্গেট। আমি মনে করি, শিক্ষা এবং শিক্ষাই পারে সমাজ ও জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে।

আপনি এশিয়ার উন্নত আর অগ্রগামী দেশগুলোর দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারবেন। তারুণ্য এক বিশাল শক্তি। এ শক্তিকে কাজে লাগালে কী হয় বা হতে পারে, তা আমাদের চাইতে ভালো কেউ জানে না। আমরা নিকট অতীতে তারুণ্যের এ শক্তি দেখেছি। প্রায় অনড় অচলায়তন ও ধসিয়ে দিয়েছে তারা। এর নাম বিপ্লব। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর ফসল ঘরে তোলা। কাউকে তাড়িয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডে তাদের আবার ফিরিয়ে আনাটা নিজেদের জন্য অহিতকর। এ কারণেই অন্নদাশংকর রায়ের কথাটি মনে করব। এ বিদ্বান বাঙালি বলেছিলেন, বাঙালি জন্মায় কেউটে হয়ে কিন্তু সারা জীবন ফোঁস করতে করতে একসময় সে ঢোঁড়া সাপ হয়ে যায়। কথাটা মারাত্মক সত্য। সবসময় আগ্রাসী বা জোশে থাকা সুস্থতা নয়। সুস্থতা হচ্ছে কাজ শেষে স্বাভাবিক জীবনযাপন।

স্বাধীনতার মূল কথাও তাই। দেশ ও জনগণের মঙ্গল। এ মঙ্গল হতে পারে বা সম্ভব তখনই যখন আমলার কাজ আমলা করবেন। কৃষক ফসল ফলাবেন। শ্রমিক শ্রম দেবেন আর রাজনীতি দেশ চালাবে। ওই যে বললাম, ইউরোপ-আমেরিকাসহ নানা দেশে গৃহযুদ্ধ এমনকি নিজেদের ভেতর মারামারিও হয়েছিল। কিন্তু সেসব অতীত তারা জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইউরোপের সব দেশের জাদুঘরে এমন সব ছবি আর কাহিনি আছে। তারা জানে, অতীতকে মনে রাখতে হয় ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখার জন্য।

কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে গিয়েছি আমি। এ দুই দেশের মানুষজন নিজেদের ভেতর যে মারামারি আর যুদ্ধ করেছিল, তা ইতিহাস বিখ্যাত। উত্তর ভিয়েতনাম আর সাউথ ভিয়েতনামের যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে তারাই আজ মিলেমিশে একাকার। কোথাও কারও সঙ্গে আলাপ করে জাতিগত উসকানি বা বিভেদ পাইনি। অথচ তাদের জাদুঘর মানেই পারস্পরিক ঘৃণা আর যুদ্ধের দলিল। তারা কীভাবে তা পারল? তাদের নেতারা জানতেন সহমর্মিতা আর সহযোগী হওয়ার নামই স্বাধীনতা। সায়গনের নাম পাল্টে হো চি মিন সিটি হলেই সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার ওপর হাত লাগায়নি উত্তরের শাসকরা। ফলে হ্যানয় আর হো চি মিন সিটির লাইফস্টাইল আলাদা। সায়গন থেকে হো চি মিন সিটি হয়ে যাওয়া নগরী অনেক বেশি আধুনিক আর আমেরিকামুখী। অন্যদিকে হ্যানয় কমিউনিস্ট প্রভাবিত। কিন্তু তারা এক দেশ এক জাতি। বৈপরীত্যের ভেতর এমন মিলনের নামই ঐক্য আর স্বাধীনতা।

আরেকটি গল্প হলো কম্বোডিয়ার। যেখানকার জাদুঘরে তাদের ভাষায় দেশবিরোধী বা একনায়ক পলপটের অনুরাগীদের মার্জনা বা মাফ চাওয়ার দলিল আছে। এ লিখিত দলিলগুলো দরকারি। এতে পরিষ্কার বোঝা যায় দোষ স্বীকার করে নেওয়া অনুতপ্তদের ভুল ছিল। এতে তারা ছোট হয়েছে কি না, জানি না; কিন্তু তাদের দেশ ও জাতির উপকার হয়েছে। ভবিষ্যতের ভুল বোঝাবুঝির নিরসন ঘটেছে। আমরা এর একটাও পারিনি। পারিনি বলেই মধ্য ষাট বয়সে এসে দেখছি কারণে-অকারণে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পড়ছে তোপের মুখে।

একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগের ঘটনা। ফরাসি বিপ্লবের সময়। তিন ব্যক্তিকে কোনো এক কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাদের টেনে আনা হয়েছে—মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

তিন ব্যক্তির প্রথমজন একজন ঘোর ঈশ্বরে বিশ্বাসী পুরোহিত। দ্বিতীয় ব্যক্তি একজন আইনজীবী। শেষেরজন একজন গবেষক, থিয়োরিটিক্যাল ফিজিসিস্ট। তাদের মাথাগুলো হেঁট করে, ঝুঁকিয়ে রাখা হয়েছে বলিকাঠের ওপর। মাথার ওপর ঝুলছে যমদেবতা। হ্যাঁ, মৃত্যুর খাঁড়া। দড়ি দিয়ে আটকানো। শুধু একটা আদেশের অপেক্ষা। আদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই খাঁড়ার ওপরের দড়ি খুলে দেওয়া হবে। সেই ধারালো লৌহ ফলকটি নেমে আসবে অপরাধীদের মাথার ওপর। শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে যাবে তাদের মস্তক। বধ্যভূমিতে পড়ে গেছে মানুষের হৈ-হট্টগোল। আজকে সবাই মিলে এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। আজ জনগণ সচক্ষে দেখতে এসেছে ভয়াবহ এ মৃত্যুদৃশ্য। যথারীতি দোষীদের তাদের জীবনের অন্তিম মুহূর্তে শেষবারের মতো কিছু বলার থাকলে, বলার জন্য সুযোগ দেওয়া হলো।

প্রথমে আমাদের আস্তিক পুরোহিতকে সুযোগ দেওয়া হলো। সে বলল—হ্যাঁ, আমি একজন ভক্ত। আমি জানি, আমি শুধু জানিই না, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, স্বয়ং ঈশ্বর আমাকে আজকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেনই। ওপর থেকে খাঁড়া নেমে এলো নিচের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য! এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। খাঁড়াটি সত্যি সত্যিই নিচে নেমে এলো তো বটে, কিন্তু পুরোহিতের গলার কাছে এসে থেমে গেল! জনগণ বিস্মিত ও ভীত। পুরোহিতকে আর সে যাত্রায় বলি চড়ানো হলো না।

এবার সেই আইনজীবীর পালা। তাকেও একই সুযোগ দেওয়াতে সে বলল—নাহ, আমি জানি আমি মরব না। যিনি সব বিচারকের ঊর্ধ্বে, ইহজগতের সব ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব-নিকাশ বিচার হয় যার আদালতে, সেই মহান সত্তা সাক্ষী আছেন, মৃত্যু আমার গর্দান আজকে কিছুতেই স্পর্শ করতে পারবে না!! অলৌকিকতা আবার পুনরাবৃত্তি করল, পুরোহিতমশাইয়ের মতোই একইভাবে, উকিলবাবুটিরও এ যাত্রায় আর মরণ হলো না। তাকেও মুক্ত করে দেওয়া হলো।

এবার শুধু বাকি সেই পদার্থবিদ। তাকে সুযোগ দেওয়া হলে, সেই মুখচোরা বিজ্ঞানী যা বলেছিলেন, তা এইরকম—হ্যাঁ, আমারও কিছু বলার ছিল বটে!! আমি ঈশ্বরের ব্যাপারে জানি খুব অল্পই, আপনারা যদি একটু কষ্ট করে নিজেদের মাথাটি তুলে, একটু খেয়াল করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, খাঁড়াটি দড়ি দিয়ে ঝুলছে বটে, কিন্তু দড়ির অন্য অংশটা আটকানো একটা কপিকল (pulley)-এর সঙ্গে। যেখান থেকে দড়িটা পেঁচিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে—অন্য কোথাও, হয়তো বাইরে।

এই গল্পটা ড. মিশিও কাকু, যিনি নিজেও একজন বিশ্ববরেণ্য থিয়োরিটিক্যাল ফিজিসিস্ট, একটা উদাহরণ টানতে গিয়ে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গল্পটা পাড়েন। তার গল্পটা শোনানোর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল এটা বলা যে, কখনো কখনো বিজ্ঞানীদেরও কোনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়লে কিছু কিছু সত্য ধৈর্যের সঙ্গে চেপে যাওয়াই ভালো!! বাঙালির জয়-বিজয়-স্বাধীনতা সব মিলিয়ে যেন ভলো থাকি আমরা।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দাপুটে জয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে সিরিজ নিশ্চিত কিউইদের

‘পরাজিত শক্তি নিউইয়র্ক টাইমসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন করিয়েছে’

মধ্যরাতে ঘরে ঢুকে প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ, অতঃপর...

আমরা কখনো বলিনি আগে নির্বাচন পরে সংস্কার চাই : মির্জা ফখরুল

পাইরেসি রুখতে শাকিবের বার্তা

বিএনপি নেতাকে কোপালেন যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতকর্মীরা

সীমান্তে ভারত-পাকিস্তান সেনাদের গোলাগুলি

তমার জন্য রাফী লাকি : নিশো 

চিপস কিনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার ৬ বছরের শিশু

ঢাকাসহ পাঁচ বিভাগে বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস 

১০

পরকীয়ার অভিযোগে খুঁটিতে বেঁধে প্রবাসীর স্ত্রীসহ যুবককে নির্যাতন

১১

সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর জঙ্গিবাদের উত্থান হয়নি : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১২

সম্প্রীতির অনন্য নজির, ঈদে এবার হিন্দুদের শরবত খাওয়াল মুসলিমরা

১৩

দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে সরকার হার্ডলাইনে যাবে : উপদেষ্টা মাহফুজ

১৪

লি‌বিয়ায় অপহৃত ২৩ বাংলাদেশি উদ্ধার

১৫

সন্ধ্যা থেকে ১২ ঘণ্টা গ্যাসের স্বল্পচাপ থাকবে যেসব এলাকায়

১৬

মেসিবিহীন আর্জেন্টিনার ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে অভিনব কীর্তি

১৭

চট্টগ্রামে বাস-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ১০

১৮

আবারও বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে মেসি

১৯

দুদিনে নিহত ১৩, চট্টগ্রামের জাঙ্গালিয়া যেভাবে মরণফাঁদ হয়ে উঠলো

২০
X