মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা শুনে নির্দ্বিধায় মনে করা যায়, তিনি কখনোই ইতিহাসের জটিলতায় মন দেননি। এমনকি আমরা মনে করতে পারি যে, ইতিহাসের কোনো ধারণাই তার নেই। গাজার জন্য তিনি যে ‘সেরা’ পরিকল্পনাটার কথা বলেছেন, তা আমাদের তার ইতিহাসবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি তার পরিকল্পনায় বলেছেন, গাজা নামে ফিলিস্তিনিদের আবাসস্থলটি সমান করে ধ্বংস হওয়া ভবনগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে, যা আমেরিকান দখল ও পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের পথ প্রশস্ত করবে।
রিফর্ম ইউকে দলের নেতা নাইজেল ফারাজ একইরকম অজ্ঞতাপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। নাইজেল গাজাকে ক্যাসিনো ও নাইটলাইফের শহর হিসেবে কল্পনা করেছেন। তিনি এমনভাবে কথা বলেছেন যেন তিনি একজন উপনিবেশবাদী। তার কাছে ইতিহাস শুরু হয় তার নিজের ভোগবিলাস থেকে।
বিজয়ী পক্ষের যুক্তি এমনই। প্রথমে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করা হয়। তারপর ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করা হয় যে, এই জমি খালি। ধ্বংসস্তূপের পেছনে যা কিছু আছে, তা অস্বীকার করা হয়। কারণ তারা মনে করে, মানুষ শুধু ধ্বংসস্তূপই দেখতে পায়।
উপনিবেশবাদীদের দীর্ঘ, রক্তাক্ত ঐতিহ্য এ রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে কথা বলে। দখলদাররা বিধ্বস্ত উপকূলে পৌঁছায়। স্থানীয়দের হত্যা করে। তারপর ঘোষণা করে যে, তারা এক ‘নতুন ভূমি’ আবিষ্কার করেছে। এ ভূমি কোনো অতীত বহন করে না। কিন্তু তারা যা-ই দেখুক বা বলুক, গাজা খালি নয়। গাজা কখনোই খালি ছিল না। প্রতিটি ফিলিস্তিনির নিঃশ্বাসে গাজা রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। বিশ্বের চোখের সামনে যা ঘটছে, তা শুধু যুদ্ধ নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক গণহত্যা—একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা গাজার অতীত মুছে ফেলার, যাতে ভবিষ্যতের জন্য তাদের দাবি অস্বীকার করা যায়।
ইতিহাস ধ্বংসের পরিকল্পনা: ইসরায়েলের হামলা শুধু জীবিতদের লক্ষ্য করেনি, এটি ইতিহাসকেও টার্গেট করেছে। দুই শতাধিক ঐতিহ্যবাহী স্থান নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এটি দুর্ঘটনা নয়, কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা, যাতে গাজাকে তার অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছে: খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যান্থেডন বন্দর, যেখান থেকে ফিনিশীয় জাহাজ একসময় সমুদ্রে যাত্রা করত, সেটি আজ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন। গাজার বৃহত্তম ও প্রাচীনতম গ্রেট মসজিদ, যা বিভিন্ন সাম্রাজ্যে টিকে থাকলেও এ যুদ্ধে টিকতে পারেনি।
সেন্ট পোরফিরিয়াস চার্চ, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খ্রিষ্টানরা প্রার্থনা করেছেন। সেটিও বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে। যখন নিরীহ বেসামরিক নাগরিকরা এর পুরোনো দেয়ালের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল তখন। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মঠও এ যুদ্ধের কবলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাংস্কৃতিক পরিচয় ধ্বংসের লক্ষ্যবস্তু: গাজার এগারো শতাধিক মসজিদ আক্রমণের শিকার হয়েছে, যার তিন-চতুর্থাংশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। তিনটি গির্জাও ধ্বংস করা হয়েছে এবং ৪০টি কবরস্থান টার্গেট করা হয়েছে। এসব কবর উন্মোচন করে মৃতদেহ পর্যন্ত চুরি করা হয়েছে বলে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গাজার অতীতকে মাটি থেকে খুঁড়ে বের করে অবমাননা করা হয়েছে। এটি শুধু ধ্বংস নয়, এটি গাজার অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা, যেন গাজার মানুষ কখনোই এ ভূমির অংশ ছিল না।
গাজার হাজার বছরের ইতিহাস: গাজা ছিল প্রাচীন। যখন রোম ছিল তরুণ। গাজা উন্নতির শীর্ষে ছিল, যখন লন্ডন ও প্যারিসের অস্তিত্ব কল্পনাও করা হয়নি। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্লিন্ডার্স পেট্রি গাজার অস্তিত্ব পাঁচ হাজার বছর আগের বলে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে কানানীয়, মিশরীয়, ফিলিস্তিনি, পার্সিয়ান ও গ্রিকরা তাদের চিহ্ন রেখে গেছেন।
ইয়েমেনের প্রাচীন আরব সভ্যতা মাইন রাজ্য খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে গাজাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র বানিয়েছিল। এখান থেকে পণ্য ভূমধ্যসাগর, ইউরোপ, মিশর ও এশিয়ায় প্রবাহিত হতো। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রপিতামহ হাশিম ইবনে আবদ মানাফ গাজায় মারা যান। তার সম্মানে শহরটির নাম হয় গাজা হাশিম।
ইসরায়েলি হামলার আসল উদ্দেশ্য: এ পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ভবন ও স্মৃতিস্তম্ভ নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারের ওপরও হামলা করেছে। গাজার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলো একসময় বিশ্বমানের বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও চিন্তাবিদ তৈরি করত, সেগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে। কারণ একজন শিক্ষিত ফিলিস্তিনি তাদের (ইসরায়েল) জন্য হুমকি, যে ইসরায়েল তাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়।
গাজা শুধু একটি শহর নয়, এটি ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিচয়ের মেরুদণ্ড। ১৯৪৮ সালের নাকবার (মহাবিপর্যয়) সময় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের গ্রাম ও শহর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্য। তখন গাজা হাজার হাজার শরণার্থীর শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। ইসরায়েলের কৌশলগত পরিকল্পনাবিদ আর্নন সফার ২০ বছর আগে গাজার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যখন ২৫ লাখ মানুষ একটি বন্দি গাজায় থাকবে, এটি এক মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হবে। আমরা বেঁচে থাকতে চাইলে আমাদের হত্যা করতে হবে, বারবার, প্রতিদিন।’ প্রথমে ইসরায়েল গাজাকে অবরুদ্ধ করল। তারপর তাদের ক্ষুধার্ত করল। এখন তারা গাজাকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে চাইছে।
শীতল গণনার পরিকল্পনা: ট্রাম্পের গাজার জন্য পরিকল্পনা হলো এক উপনিবেশবাদীর পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা শুধু প্রাণ সংহার ও হাসপাতাল ধ্বংসে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি মৃতদেরও মুছে ফেলতে চায়। গাজাকে এক শূন্যতায় পরিণত করতে চায়। যেন এখানে কখনোই কেউ ছিল না। এটি সেই একই কৌশল, যা আমেরিকার আদিবাসীদের গণহত্যা, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিধন, এবং প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিশ্চিহ্নতার পেছনে কাজ করেছে। সবকিছুই তারা করেছে সভ্যতা ও অগ্রগতির নামে।
গাজার মানবিক ঐতিহ্য: সেদিন একজন মধ্যবয়সী ফিলিস্তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ওপর বসেছিলেন। তার শরীরে ধুলো লেগে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনি কেন চলে যাচ্ছেন না?’ তিনি শান্ত, কিন্তু অবিচল কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছেলে এখানে মারা গেছে। তার রক্ত এখানেই ঝরেছে। তার কঙ্কাল এখানেই শুয়ে আছে। এখানে বসে আমি তার কাছে থাকার অনুভূতি অনুভব করি।’ এই একটি বাক্যের মধ্যে হাজারো অজানা গল্পের ভার লুকিয়ে আছে।
বিশ্বের কাছে গাজা ধ্বংসস্তূপ মাত্র। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য এটি পবিত্র ভূমি। সেখানে ধুলোয় তাদের স্মৃতি শ্বাস নেয়। সেখানে হারানো স্বজনদের হাসির প্রতিধ্বনি রয়ে গেছে। গাজার ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না। গাজাকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে, ধ্বংস নয়। কারণ গাজা মানবতার উত্তরাধিকার।
লেখক: ব্রিটিশ-তিউনিসীয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ। তার লেখা দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, কোরিয়েরে দেলা সেরা, আলজাজিরা, আল কুদসে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটি মিডল ইস্ট আইয়ের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন আবিদুর রহমান
মন্তব্য করুন