অপরাধী কিংবা অপরাধের অভিযোগে গণপিটুনি বা হত্যার মতো ঘটনায় যেন সাধারণ মানুষ না জড়িয়ে পড়েন, ব্যাপারটিতে সরকার প্রশাসনসহ সচেতন মহলের আহ্বান সত্ত্বেও ঘটেই চলেছে এসব ঘটনা। এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগ ও হতাশার। কেননা এসব ঘটনা একদিকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, যেখানে রাষ্ট্র কাউকে সে অধিকার দেয়নি। অন্যদিকে, নিরপরাধ ব্যক্তিও হতে পারেন নৃশংসতার শিকার।
গত শনিবারও বরিশাল নগরীতে চার বছরের শিশু ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে বিক্ষুব্ধ স্থানীয় জনতা। নিহত ব্যক্তির নাম সুজন। এদিন সন্ধ্যায় নগরীর ধান গবেষণা রোডে স্থানীয়রা তাকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। এরপর রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় শিশুর বাবা শনিবার সন্ধ্যায় থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে ভুক্তভোগীকে একটি রান্নার পাত্র ফেরত দিতে প্রতিবেশী সুজনের বাড়িতে পাঠান। শিশুটিকে এক পেয়ে সুজন ধর্ষণচেষ্টা চালান। তখন শিশুটি চিৎকার দিলে অভিযুক্ত পালিয়ে যান। কিন্তু নিহতের স্বজনদের দাবি, পূর্বশত্রুতার জেরে মিথ্যা অভিযোগ তুলে পরিকল্পিতভাবে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
এর আগে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পরকীয়া সন্দেহে স্বামী-স্ত্রীকে বেধড়ক মারধর করা হয়। শ্লীলতাহানি ও মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও করার অভিযোগও ওঠে ওই ঘটনায়। অভিযোগটি ছিল একই এলাকার বেশ কয়েকজন যুবকের বিরুদ্ধে। থানায় করা ভুক্তভোগীর অভিযোগ বলছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তার দ্বিতীয় স্বামী শামীমকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে তেগাছিয়া থেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য চাপলী বাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময় তুলাতলী এলাকায় পৌঁছলে এলাকার ওই যুবকরা মোটরসাইকেল থামিয়ে বেধড়ক মারধর শুরু করে। করা হয় শ্লীলতাহানি। পরে তাদের কলাপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনাটি সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বেশ আলোচিত হয়।
সম্প্রতি দেশব্যাপী একের পর এক আলোচিত ধর্ষণের ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-বিরোধিতা করছে। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। তবে এ অপরাধের অভিযোগে যে গণধোলাই বা গণপিটুনির সংস্কৃতি বা প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই ভয়াবহ। আমরা জানি, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এই নাজুক অবস্থার সুযোগে দেশব্যাপী বেড়েছে নানা অপরাধ প্রবণতা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বেড়েছে চুরি-পকেটমারি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। এসব ঘটনায় বেড়েছে গণধোলাইয়ের মতো ঘটনা; সঙ্গে আহত ও নিহতের সংখ্যাও। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে, শত্রুতার জেরে পরিকল্পিতভাবে মব সৃষ্টি করে কেউ কারও বিরুদ্ধে সহিংসতা ভাঙচুর বা মেরে ফেলার মতো ঘটনা যে ঘটাতেই পারে—এ কথা বলাই বাহুল্য। শনিবার বরিশালের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি আসলেও তেমন অপরাধ করেছেন কি না, আমরা কেউই তা জানি না। কিন্তু এ অভিযোগে তাকে মেরে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আধুনিক ও সভ্য দুনিয়ায় এটি বেমানান।
আমরা মনে করি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে প্রত্যেকের সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। কেউ অপরাধ করলে তাকে বিচারের জন্য দেশে আইন রয়েছে, সেখানেই সোপর্দ করা উচিত। বিনা বিচারে কাউকে মেরে ফেলার অধিকার কারও নেই। এতে করে আইনের লঙ্ঘন এবং সমাজে বিশৃঙ্খলাই বাড়ে। এ পরিস্থিতির সুযোগে বা মবকে ব্যবহার করে বাড়তে পারে পরিকল্পিত অপরাধ তৎপরতা। তাই গণপিটুনিকে না বলুন।
মন্তব্য করুন